রতুয়া গ্রামের হাওয়ায় সেদিন এক অদ্ভুত উৎসবের আমেজ। শীতের সন্ধ্যা, সারা গ্রাম আলোয় ঝলমল করছিল। বিশ্বজিৎ কর্মকারের ভাগ্নির বিয়ের তোড়জোড় তুঙ্গে। হাসি-ঠাট্টা, গান আর আলোচনায় ভরপুর ছিল তার পরিবার। বিশ্বজিৎ, বয়স মাত্র পঁচিশ, ভাগ্নির বিয়ের আয়োজন নিয়ে দারুণ ব্যস্ত ছিলেন। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেওয়া তার দায়িত্ব।
শুক্রবার বিকেলবেলা, নিজের পুরনো বাইকটা নিয়ে বের হলেন বিশ্বজিৎ। তার সঙ্গে যোগ দিল ভোলা, তার শ্যালক, এবং ভোলার বন্ধু এনাফুল। বাইকে চড়ে তিনজন পাড়ি দিলেন ভালুকা। বিয়ের কার্ড পৌঁছে দিয়ে সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে আসার পরিকল্পনা ছিল। রাস্তার ধারে ধানের ক্ষেতে শীতল বাতাস গায়ে লাগতে লাগতে, তিনজনের মধ্যেই চলছিল মজার গল্প।
ভালুকা পৌঁছে নিমন্ত্রণপত্র দেওয়া শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেল। তবুও তাদের মুখে ছিল আনন্দের ছাপ। বিশ্বজিৎ হালকা হাসি হেসে বললেন, “চল, এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যাই। সকালে আবার কাজ আছে।” বাইক স্টার্ট দিয়ে তিনজন দ্রুত বাড়ির পথে রওনা দিলেন।
রতুয়ার পথে শীতের রাত ছিল কুয়াশায় ঢাকা। রাস্তার দৃশ্যও ঝাপসা। বাইক চালানোর দায়িত্ব ছিল বিশ্বজিতের হাতে। তিনি সাবধানে চালাচ্ছিলেন, কিন্তু রাস্তার মোড়ে মোড়ে কুয়াশা ঘন হয়ে আসছিল। এক সময় তারা নাকাট্টি ব্রিজের কাছে পৌঁছাল।
হঠাৎ, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, বাইকটি রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাক্টরে সজোরে ধাক্কা মারে। ধাক্কা এতটাই তীব্র ছিল যে তিনজনই ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলেন। বাইকটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল। বিশ্বজিৎ, ভোলা, আর এনাফুলের নিথর দেহ রক্তে ভিজে রাস্তার পাশে পড়ে রইল।
পথচারীরা ছুটে এলেন চিৎকার শুনে। একজন সঙ্গে সঙ্গে রতুয়া থানায় খবর দিল। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনটি দেহ উদ্ধার করল। সব কিছু থমকে গেল এক নিমেষে। আনন্দের উচ্ছ্বাস মুহূর্তেই পরিণত হলো গভীর শোকে।
পরের দিন সকালে রামায়ণপুর গ্রাম যেন নীরবতার ভারে চাপা পড়ে গেল। বিশ্বজিতের পরিবারের কান্না থামছিল না। বিয়ের আলোয় সাজানো বাড়িটা যেন শোকের ঘন অন্ধকারে ডুবে গেল। ভাগ্নি, যে কয়েক ঘণ্টা আগে খুশির স্বপ্নে বিভোর ছিল, সেই এখন শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছছে।
ভোলার মা দিশেহারা হয়ে ছুটে আসছিলেন। চিৎকার করে বলছিলেন, “আমার ভোলা ফিরবে না? ওর শখ ছিল বিয়েতে নতুন জামা পরার। আমার ছেলেটা কই?” আর এনাফুলের বাবা-মা, যারা এই দুর্ঘটনার খবর শুনে উত্তর দিনাজপুর থেকে ছুটে এসেছেন, তারা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে ছিলেন।
এদিকে পুলিশ তদন্ত শুরু করল। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেল, ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক্টরটির কোনো সংকেত আলো জ্বলছিল না। গভীর কুয়াশার মধ্যে সেটি দৃশ্যমান ছিল না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ট্রাক্টরের চালককে খুঁজতে শুরু করল পুলিশ।
গল্পটা এখানেই শেষ নয়। বিশ্বজিৎ, ভোলা, আর এনাফুলের এই মর্মান্তিক পরিণতি পরিবারের সদস্যদের জন্য এক অনন্ত শোক রেখে গেল। কিন্তু তাদের স্মৃতি এখনো গ্রামবাসীদের মনে জ্বলজ্বল করছে। ভাগ্নির বিয়ের নিমন্ত্রণের সেই আনন্দঘন মুহূর্তকে এক করুণ কাহিনিতে বদলে দিয়ে গেল এক রাতের দুর্ঘটনা।
জীবন কতটা অনিশ্চিত, সেই সত্যিটাই যেন বারবার মনে করিয়ে দেয় এই গল্প। বিয়ের আনন্দের মাঝেও পরিবারটি আর কোনোদিন সম্পূর্ণ হবে না। রতুয়া গ্রামের মানুষ সেদিন শিখেছিল, বিয়ের আলো আর শোকের অন্ধকার কখনও কখনও একই ছাদের নিচে বসে থাকে।
|| সমাপ্ত ||
_______