মেন্দাবাড়ি গ্রামের সকালগুলো সাধারণত শান্তিপূর্ণ হয়। গ্রামের মহিলারা প্রতিদিনের মতো এদিনও দল বেঁধে জঙ্গলে গিয়েছিল। মৃদু আলো, ঝিঁঝি পোকার ডাক, আর জঙ্গলের ছায়ায় জ্বালানির কাঠ সংগ্রহ করাই ছিল তাঁদের কাজ। কিন্তু এই নিরীহ যাত্রা রূপ নেবে এক বিভীষিকায়, তা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
চাঁদমনি ওরাও, রেখা বর্মন, আর তাঁদের সঙ্গীরা কাঠের বোঝা কাঁধে নিয়ে যখন বাড়ির পথে পা বাড়াচ্ছিলেন, তখন হঠাৎই জঙ্গলের গভীর থেকে ভেসে এল এক অদ্ভুত গর্জন। দাঁতাল হাতিটি যেন তাঁদের উপস্থিতি টের পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। মুহূর্তের মধ্যেই বিশালাকৃতির হাতিটি জঙ্গলের ঘন সবুজ আচ্ছাদন ছিঁড়ে বেরিয়ে এল।
“দৌড়াও!”—চাঁদমনির চিৎকারে দলের সবাই দিকভ্রান্ত হয়ে ছুটতে লাগল। কিন্তু দাঁতাল হাতিটির ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ ছিল না। সে শূড় তুলে একের পর এক মহিলাকে আঘাত করতে শুরু করে। চাঁদমনি আর রেখা রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও হাতিটি শূড় দিয়ে তাঁদের তুলে আছাড় মারে। মুহূর্তেই তাঁদের নিথর দেহ পড়ে থাকে মাটিতে। আর এক মহিলা, মীনা, প্রাণপণে দৌড়াতে চেষ্টা করেও হাতিটির আক্রমণে গুরুতর জখম হন।
গ্রামের বাকি মহিলারা আতঙ্কে জঙ্গলের দিকে ছুটে যায়। কেউ কেউ মেন্দাবাড়ির গ্রামে পৌঁছে খবর দেয়। স্থানীয় লোকজন, পুলিশ আর বন বিভাগের আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। চাঁদমনি আর রেখার দেহ উদ্ধার করা গেলেও, অন্য এক মহিলার সন্ধান তখনও পাওয়া যায়নি। আহত মীনাকে তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
জঙ্গলের এই ভয়ঙ্কর ঘটনায় গ্রামে নেমে আসে শোকের ছায়া। চাঁদমনি আর রেখার পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। আলিপুরদুয়ারের জেলা পরিষদের সভাধিপতি স্নিগ্ধা শৈব হাসপাতালে গিয়ে আহত মহিলার সঙ্গে দেখা করেন এবং পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
বন বিভাগের কর্মীরা জানান, দাঁতাল হাতিটির আচরণ ছিল অস্বাভাবিক। তাঁদের ধারণা, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে জঙ্গলের মধ্যে মানুষের অনুপ্রবেশ এবং কাঠ সংগ্রহের জন্য জঙ্গলের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় হাতিটি অস্থির হয়ে উঠেছিল। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছে ভিন্ন কথা। তাঁদের দাবি, হাতিটির আচরণ প্রতিশোধের মতো ছিল।
কয়েক দিন আগেই হাতিটির বাচ্চাকে লোকেরা ভয় দেখিয়ে জঙ্গলের অন্য পাশে তাড়িয়ে দিয়েছিল। হয়তো সেই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে দাঁতাল হাতিটি মানুষকে আক্রমণ করেছে।
এই ঘটনা নতুন করে মনে করিয়ে দিল মানুষ আর প্রকৃতির সংঘাতের কথা। মানুষ জঙ্গলে প্রবেশ করে নিজেদের প্রয়োজনে যা ইচ্ছা তাই করে, কিন্তু জঙ্গলের প্রাণীরা তখনই নিজেদের ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। মেন্দাবাড়ির ঘটনাটি প্রকৃতির এই নীরব প্রতিবাদেরই একটি রূপ।
হয়তো একদিন মানুষ প্রকৃতির প্রতি তাদের দায়িত্ব বুঝতে শিখবে। কিন্তু সেই দিন আসার আগে আরও কত চাঁদমনি আর রেখাকে হারাতে হবে?
|| সমাপ্ত ||
________