খড়িয়াল বাগপাড়া এলাকার লোকজন হঠাৎই অস্বাভাবিক কিছু টের পায়। বাড়ির উঠোনে অচেনা পায়ের ছাপ, মুরগির খাঁচা খোলা, আর মাঝেমধ্যে ছাগল বা হাঁস গায়েব। প্রথমে কেউ গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ ধরে যখন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যায়, তখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
শুভমাল্য, গ্রামের এক তরুণ, এক রাতে উঠোনে শব্দ শুনে বাইরে বের হয়। টর্চের আলোতে সে দেখতে পায় বড়ো আকারের ছায়ামূর্তি। মূর্তিটি ঝোপের মধ্যে চলে যায়। শুভমাল্য দেখে কিছুটা রক্ত মাটিতে পড়ে আছে। সেদিন সকালে সে তার হাঁসটি খুঁজে পায়নি।
গ্রামে গুজব শুরু হয়, এটা চিতা বাঘ হতে পারে। কেউ বলে, এটা নেকড়ে। তবে এক বৃদ্ধ বলেন, “এটা মেছো বাঘ। নদীর কাছের জঙ্গলে এদের দেখা যায়।” লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। কেউ কেউ বন দফতরে খবর দেয়।
বন দফতর থেকে কর্মীরা এসে গোপনে কয়েকটি ক্যামেরা বসিয়ে যায়। তিনদিন পর ছবিতে ধরা পড়ে একটি বাঘরোল। কিন্তু গ্রামের লোকেরা প্রথমে তা বিশ্বাস করতে রাজি হয় না। ছবি দেখে অনেকেই বলে, “এ তো চিতা বাঘের মতো!”
এক রাতে, গ্রামের প্রবেশপথে একটি বাড়ির উঠোনে দেখা যায় বাঘরোলটি। সেই বাড়ির বৃদ্ধা চিৎকার করে ওঠেন। সঙ্গে সঙ্গেই লোকজন লাঠি নিয়ে ছুটে আসে। কিন্তু প্রাণীটি পালিয়ে যায়।
বন দফতরের এক কর্মী, সোমনাথ, গ্রামে এসে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বাঘরোল বিপজ্জনক নয়। সে জানায়, এটি বাংলার রাজ্য প্রাণী এবং খুবই বিলুপ্তপ্রায়। সোমনাথ বলেন, “ওরা শুধু খাবারের খোঁজে আসে। আপনারা এদের ক্ষতি করবেন না। বরং আমাদের খবর দিন।”
লোকেরা বন দফতরের কথা শুনতে চায়, কিন্তু ভয় তাদের জড়িয়ে ধরে। তারা বলে, “আমাদের ছাগল গায়েব হয়ে যাচ্ছে। বাচ্চারা রাতে ঘরের বাইরে বেরোতে পারছে না। যদি আক্রমণ করে?”
সোমনাথ গ্রামে একটি সচেতনতার সভার আয়োজন করেন। তিনি বলেন, “বাঘরোল সাধারণত মাছ, পাখি, এবং ছোট প্রাণী খায়। মানুষকে আক্রমণ করে না। জঙ্গলের খাবারের অভাব হলে ওরা লোকালয়ে আসে। খাবার সরবরাহ বন্ধ করলে ওরা আপনাআপনি ফিরে যাবে।”
গ্রামের লোকজন সোমনাথের পরামর্শে কয়েকটি বড়ো মুরগির খাঁচা বানায়। হাঁস-মুরগিকে রাতে সুরক্ষিত রাখতে শুরু করে। এদিকে, বন দফতরের পক্ষ থেকে জঙ্গলে কিছু খাবার রাখা হয়।
একদিন, বাঘরোলটি গ্রামের এক ধারে ধরা পড়ে। বন দফতরের কর্মীরা সেটিকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা প্রথমবার কাছ থেকে দেখে প্রাণীটির শান্ত স্বভাব। তারা বুঝতে পারে, এটি চিতা বাঘ নয়।
আতঙ্ক কমে আসে। গ্রামের শিশুরা আবার সন্ধ্যায় খেলতে শুরু করে। গ্রামবাসীদের মধ্যে বন দফতরের প্রতি আস্থা বাড়ে।
সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গ্রামে বন দফতর একটি পোস্টার ক্যাম্পেইন চালু করে। কেয়ার টেকাররা প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আরও ব্যবস্থা নেবে।
গ্রামের বৃদ্ধা, যিনি প্রথম বাঘরোল দেখে চিৎকার করেছিলেন, এখন সবাইকে বোঝান যে এদের নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
একদিন, এক মেয়েকে দেখা যায় তার বাড়ির উঠোনে একটি বাঘরোলের বাচ্চা নিয়ে খেলতে। সে বন দফতরকে জানায় এবং বাচ্চাটিকে নিরাপদ স্থানে পাঠানো হয়।
গ্রামের লোকেরা এখন বাঘরোলের অস্তিত্বকে মেনে নিয়েছে। তারা বুঝেছে, মানুষ এবং প্রকৃতির সহাবস্থান সম্ভব।
সেই দিনগুলো গ্রামে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু সচেতনতা এবং মানবিকতা কীভাবে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে, তার উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায় খড়িয়াল বাগপাড়া।
“রাতের অতিথি” বাঘরোল গ্রামে যে বার্তা দিয়ে গেল, তা হলো, ভয় ও বিভ্রান্তির বদলে যদি সচেতনতা ও বোঝাপড়া দিয়ে পরিস্থিতি সামলানো যায়, তবে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে এক সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
|| সমাপ্ত ||
________