সকালটা ছিল মেঘলা। রামগঙ্গা ঘাটে নদীর ধারে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে একদল বনকর্মী চুপচাপ এগোচ্ছিল। তাঁদের চোখে-মুখে সতর্কতা, কারণ কিছু দিন ধরেই গোপন খবর আসছিল, এই অঞ্চলে হরিণ শিকার বেড়ে গেছে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন অভিজিৎ সেনগুপ্ত। অভিজ্ঞ এই বনকর্মী সুন্দরবনের প্রত্যেকটি কোণা চেনেন হাতের তালুর মতো।
“সতর্ক থাকো,” ফিসফিস করে দলের বাকিদের বললেন অভিজিৎ। তাঁর অভিজ্ঞতা বলছে, চোরাশিকারীরা সাধারণত দিনের এই সময়টাই সক্রিয় হয়।
ওইদিকে ঝোপের পিছনে, তপন মল্লিক নামের এক ব্যক্তি নিজের ফাঁদ খুলতে ব্যস্ত। হাতে ধারালো ছুরি, চোখে ভীতিকর চাউনিতে শিকারের অপেক্ষা। হরিণ ধরা তাঁর পেশা, যা পুরোপুরি অবৈধ। কিন্তু দরিদ্র পরিবার আর লোভ তাঁকে বাধ্য করে এই পথে নামতে।
হঠাৎ পাশের জঙ্গলে একটা আওয়াজ। তপন কিছু বুঝে ওঠার আগেই অভিজিতের দল তাঁকে ঘিরে ধরে।
“তপন মল্লিক, তুমি ধরা পড়েছ!” অভিজিৎ দৃঢ় গলায় বললেন। তপনের হাতে তখনও ছুরি। পালানোর চেষ্টায় ছিলেন তিনি, কিন্তু বনকর্মীদের কঠোর উপস্থিতিতে সেটা সম্ভব হলো না।
তপনের ব্যাগ খুলতেই দেখা গেল প্রায় ২৫ কেজি হরিণের মাংস। আর ছিল হরিণের একটি চামড়া। দলের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল।
তপনকে হাতকড়া পরিয়ে যখন তাঁকে গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন তাঁর চোখে এক ধরনের কূট চিন্তা দেখা গেল। অভিজিৎ সেটা লক্ষ করলেও চুপ রইলেন।
পথে তপন একবার জিজ্ঞেস করল, “আপনারা জানেন, আমিই একা না। আমার পিছনে আরও অনেক আছে।”
অভিজিৎ বুঝলেন, তপনকে জেরা করলেই চোরাশিকারী চক্রের গভীরতা ধরা যাবে। তাঁর কাছে ফরেন্সিক টিমের কাছে মাংস আর চামড়ার পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগে কিছু করা সম্ভব নয়।
রাতে তপনকে স্থানীয় থানায় রাখা হলো। অভিজিৎ সেই রাতেই বনদফতরের ফাইল খুলে সুন্দরবনের অন্যান্য চোরাশিকারীদের নাম খুঁজতে শুরু করলেন। এক পুরনো ডকেট থেকে তিনি কিছু নতুন তথ্য পান।
অন্যদিকে, তপনের স্ত্রী মাধুরী মল্লিক রাতে খুবই আতঙ্কে ছিলেন। তাঁর স্বামী ধরা পড়েছে শুনে তিনি জানতেন, এর পরিণতি ভালো কিছু হবে না।
পরদিন সকালে তপনকে আদালতে তোলা হলো। আদালতে অভিজিৎ তাঁর বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ পেশ করলেন। বিচারক তাঁর বনদফতরের হেফাজতে আরও তিনদিনের অনুমতি দিলেন।
হেফাজতে নিয়ে তপনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। প্রথমে তিনি কিছু বলতে চাননি। কিন্তু একসময় স্বীকার করলেন, তাঁর সঙ্গে আরও তিনজন রয়েছে, যারা জঙ্গলে শিকার চালায়।
“ওরা প্রতিবার সজাগ থাকে,” তপন বলল। “তাই একবারেই পুরো চক্র ধরা সম্ভব নয়।”
তপনের তথ্য অনুযায়ী, অভিজিৎ আর তাঁর দল একটি বিশেষ অভিযানের প্রস্তুতি নিল। পাথরপ্রতিমার জঙ্গলে এবার নজরদারি আরও কড়া হলো।
তারা গভীর রাতে জঙ্গলে অভিযান শুরু করল। আধুনিক ড্রোন ক্যামেরা আর নাইট ভিশন যন্ত্র নিয়ে তাঁরা জঙ্গলের প্রতিটি কোণা খুঁজে দেখছিল।
হঠাৎই ড্রোনে কিছু লোকের চলাফেরার ছবি ধরা পড়ল। দ্রুত সেখানে পৌঁছে অভিজিৎ এবং তাঁর দল তিনজন চোরাশিকারীকে হাতে-নাতে ধরল।
তাদের কাছ থেকেও মাংস, চামড়া, এবং শিকারের যন্ত্র উদ্ধার হলো। ফরেন্সিক পরীক্ষার পর জানা গেল, এরা অনেক দিন ধরেই এই চক্র চালাচ্ছে।
অভিযানের সাফল্যে স্থানীয় গ্রামবাসীরা আনন্দিত। বন দফতরের এই সাফল্যে তাঁরা নিজেদের নিরাপদ মনে করতে লাগলেন।
শেষমেশ, অভিজিৎ বললেন, “সুন্দরবন শুধু আমাদের নয়, এখানকার প্রাণীদেরও ঘর। তাদের রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।” তাঁর কথায় সকলেই সম্মতি জানাল। সুন্দরবন আবার একটু বেশি সুরক্ষিত হলো।
|| সমাপ্ত ||
________