তীব্র রোদে চলছিল শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে যাত্রা শুরু করা ট্রেনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরায় ভ্রমণরত যাত্রীদের জন্য ছিল স্বস্তির জায়গা। তবে কেউ জানত না, একটু পরেই সেই শান্ত ভ্রমণ ভয়াবহ আতঙ্কে পরিণত হবে।
ট্রেনটি যখন হুগলির গুড়াপ স্টেশনের কাছে পৌঁছায়, তখন হঠাৎই বিকট এক শব্দ হল। মনে হচ্ছিল যেন নিচ থেকে কোনো ভারী যন্ত্র খুলে পড়েছে। ডি-ওয়ান কামরার যাত্রীদের চোখে-মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল।
একজন প্রথমে বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেননি। “মনে হয়, সামান্য ত্রুটি।” কিন্তু যখন ট্রেনের তলা থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করল, তখন যাত্রীরা বুঝতে পারলেন বিষয়টি গুরুতর। ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল।
ট্রেন তখনও চলছে। নিচ থেকে ঘষার বিকট শব্দ ধীরে ধীরে আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে লাগল। কামরার নিচে থাকা একটি যন্ত্রাংশ খুলে মাটির সঙ্গে লেগে আগুনের ফুলকি তৈরি করছিল। পাথরের টুকরো উড়ে এসে জানালার কাচ ভাঙতে শুরু করল।
“ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে যাবে!” কোনো এক যাত্রীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর শুনে পুরো কামরায় হুলুস্থুল পড়ে গেল। আতঙ্কিত যাত্রীরা চিৎকার করতে করতে উঠে দাঁড়ালেন। কেউ জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখতে চাইছিলেন কী হচ্ছে, আবার কেউ দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছিলেন।
হঠাৎ করে ট্রেনটা এক ঝটকায় থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই অনেক যাত্রী ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন। আতঙ্কে কিছু যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে দৌড়াতে শুরু করলেন।
পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছিল। ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে আসছিল অনেকের। দমকল ও রেল কর্তৃপক্ষকে খবর দেওয়া হলেও, সাহায্য পৌঁছাতে সময় লাগবে। মাঝখানে আতঙ্ক আরও বেড়ে গেল।
কলকাতা থেকে বোলপুর বেড়াতে যাওয়া সাগরিকা দত্ত, যিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে ছিলেন, বললেন, “এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, সব শেষ। মনে হচ্ছিল, ট্রেনটা উলটে যাবে।”
কামরার জানালা ভেঙে ধুলো আর ধোঁয়া ভেতরে ঢুকছিল। যাত্রীরা কেউ কারো কথা শুনতে পাচ্ছিলেন না। কল্যাণী দেব ও আঁখি অধিকারী পরে বলেন, “এমন একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি যেন মৃত্যুর দুয়ারে নিয়ে গিয়েছিল।”
রেলের টেকনিশিয়ানরা দ্রুত সেখানে উপস্থিত হলেন। কিন্তু ততক্ষণে যাত্রীদের মনে ভয় বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল। টেকনিশিয়ানদের কাজ শুরু করতে একটু সময় লাগল।
কামরার নিচে থাকা যন্ত্রাংশ খুলে যাওয়ার ফলে পুরো ট্রেনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়েছিল। যদি আর একটু দেরি হতো, তাহলে ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।
সাগরিকার ছেলে বৃষ্টির মতোই আতঙ্কে কাঁপছিল। “মা, আমরা কি বাঁচব না?” বলছিল সে। সাগরিকা নিজেই আতঙ্কিত, তবে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
ট্রেনের বাইরে থাকা যাত্রীরা দমকল এবং রেলের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। কিন্তু কারও মনে তেমন আশার আলো ছিল না। চারদিকে শুধু চিৎকার আর আতঙ্ক।
প্রায় এক ঘণ্টা চেষ্টা করার পর যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত করা গেল। তবে কাজ করার সময় টেকনিশিয়ানদের এক মুহূর্তের ভুল হলেও সেটা মারাত্মক হতে পারত।
মেরামতির পর ট্রেনটি আবার চলতে শুরু করল। তবে যাত্রীরা তখনও আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেননি। যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত তাঁদের কাছে মনে হচ্ছিল একটা ঝুঁকি।
বোলপুর স্টেশনে পৌঁছানোর পর যাত্রীরা একে একে ট্রেন থেকে নামতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁদের মুখে ছিল তীব্র ক্ষোভ। “রেল কতটা গাফিলতি করলে এমন ঘটনা ঘটে?” প্রশ্ন তুললেন সাগরিকা।
যাত্রী ইন্দ্রাণী বসু বললেন, “কামরার নিচের যন্ত্রাংশ যদি চলন্ত ট্রেনে খুলে যায়, তাহলে আর নিরাপত্তা বলে কিছু থাকে না। আমরা কীভাবে রেলে ভরসা করব?”
পূর্ব রেলের এক আধিকারিক পরে জানালেন, “এটি একটি যান্ত্রিক ত্রুটির ফল। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছি বলে বড় কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। যাত্রীদের অসুবিধার জন্য আমরা দুঃখিত।”
যাত্রীদের এই ত্রাসের অভিজ্ঞতা তাঁদের মনে দাগ কেটে গেল। সাগরিকা দত্ত বললেন, “এই ঘটনার পরে আর কখনও ট্রেনে উঠতে সাহস পাব না।”
ঘটনার দিনটি অনেকের কাছে জীবনের এক ভয়াবহ অধ্যায় হয়ে থাকবে। তবে এর মধ্যেও আশার কথা একটাই—দ্রুত পদক্ষেপের ফলে একটা বড় দুর্ঘটনা এড়ানো গেছে। কিন্তু রেলের গাফিলতির প্রশ্ন রয়ে গেল, যার উত্তর হয়তো কখনোই মিলবে না।
|| সমাপ্ত ||
________