শীতের এক সকালে ধনঞ্জয়পুর গ্রামের আকাশটা ছিল ধূসর। মানুয়ারা বেগম রান্নাঘরের উনুনে বসে ঘুগনি রান্নায় ব্যস্ত। আগুনের শিখা উজ্জ্বল হয়ে লকলক করছিল, আর মশলার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল সারা বাড়িতে। রান্নাঘরের পাশেই দেড় বছরের ছোট্ট আকসাম হামাগুড়ি দিতে দিতে খেলছিল। তার ছোট্ট হাত দু’টি মাটি ছুঁয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ছিল তার নিষ্পাপ মুখে।
মানুয়ারা রান্নার মাঝে হঠাৎ মনে পড়ল, মশলার শিশিটি ঘরের ভিতরে রয়ে গেছে। তড়িঘড়ি উনুন থেকে গরম ঘুগনির কড়াইটি নামিয়ে পাশে রাখলেন। শিশুটি নিরাপদে আছে ভেবে, রান্নাঘর ছেড়ে তিনি ঘরে ঢুকে গেলেন। তবে সময় যে এমন নিষ্ঠুর হতে পারে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি।
কিছুক্ষণ পরেই এক তীব্র দড়াম শব্দে চমকে উঠলেন মানুয়ারা। দৌড়ে ফিরে এলেন রান্নাঘরে। দৃশ্যটি দেখে মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে গেলেন। কড়াই গড়াচ্ছে মেঝেতে, আর তার মধ্যে তার আদরের সন্তান আকসাম পড়ে ছটফট করছে। গরম ঘুগনির কড়াইয়ের তীব্র তাপে শিশুটির করুণ আর্ত চিৎকার বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। মুহূর্তের মধ্যেই মানুয়ারা চিৎকার করে উঠলেন, “ও আল্লাহ! কেউ বাঁচাও আমার ছেলেকে!”
চিৎকার শুনে পরিবারের সদস্য এবং প্রতিবেশীরা ছুটে এলেন। শিশুটিকে দ্রুত কড়াই থেকে তুলে কাপড়ে জড়িয়ে সবাই মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আকসামের ছোট্ট শরীরের ৯০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। মুরারই হাসপাতাল, রামপুরহাট মেডিক্যাল, তারপর বর্ধমান মেডিক্যাল— চিকিৎসার জন্য ছুটোছুটি চলল। কিন্তু ততক্ষণে সময় যেন হাতের মুঠো থেকে ফসকে গেছে।
চার দিন ধরে চিকিৎসকরা চেষ্টা করেও আকসামের জীবনরেখা টিকিয়ে রাখতে পারলেন না। শুক্রবার সকালে তার ছোট্ট হৃদয় থেমে গেল। আকসামের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছতেই ধনঞ্জয়পুরের প্রতিটি ঘর শোকের অন্ধকারে ডুবে গেল। মানুয়ারার কান্নার আওয়াজে আকাশ ভারী হয়ে উঠল।
পুলিশ ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করল। তবে গ্রামের মানুষজনের মনোযোগ ছিল অন্যত্র। তারা ভাবছিল, এই মর্মান্তিক ঘটনার দায় কি শুধুই ভাগ্যের উপর? নাকি এমন দুর্ঘটনা রোধের জন্য সতর্কতা আরও বাড়ানো উচিত?
শিশুর মৃত্যুর পর ধনঞ্জয়পুরের মানুষ প্রতিজ্ঞা করল, তারা আর কখনো ছোট্ট শিশুদের রান্নাঘরের কাছে আসতে দেবে না। মা মানুয়ারা এখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করেন— যেন কোথাও, কোনোভাবে, তার আকসাম আবার ফিরে আসে।
অন্তহীন শোকের মাঝেও তার মনে একটাই প্রশ্ন: “কেন? কেন এমন হলো?”
|| সমাপ্ত ||
________