জীবনে অনেক কঠিন মুহূর্ত আসে। কখনো মনে হয়, হয়তো এটাই শেষ, এখানেই থেমে যাবে সব। কিন্তু যদি মনের ইচ্ছা অটুট থাকে, তাহলে কোনো বাধাই পথ আটকাতে পারে না। এই সত্যিটাই প্রমাণ করেছেন হুগলির ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটির ২৮ বছরের অনুপ সিং। দুই চোখে দৃষ্টি নেই, কিন্তু তাতে জীবন থেমে থাকেনি। বরং জীবনের প্রতিটা প্রতিকূলতাকে জয় করে অনুপ এগিয়ে চলেছেন নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে।
অনুপের জীবনের গল্প শুরু হয় এক ভয়াবহ ঘটনার মধ্য দিয়ে। মাত্র নয় মাস বয়সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে একে একে হারিয়েছিলেন দু’চোখের দৃষ্টি। চিকিৎসা করিয়েও কোনো ফল হয়নি। ছোট্ট অনুপের জীবনে এই অন্ধকার যেন সব আলো ঢেকে দেয়। কিন্তু তখন থেকেই তার মধ্যে শুরু হয় লড়াই করার মানসিকতা।
অনুপের মা গীতা সিং উত্তরপ্রদেশ থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে হুগলিতে চলে আসেন। তার স্বামী তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বহু বছর আগে। গীতা এক হাতে সন্তানদের মানুষ করতে নিজের সবটা উজাড় করে দেন। অন্যের বাড়িতে রান্নার কাজ করে, ঋণ নিয়ে, সন্তানদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। বড় ছেলে অনুপ ছোট থেকেই দৃষ্টিহীন। কিন্তু গীতার একমাত্র স্বপ্ন ছিল—তার ছেলে যেন বড় হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ায়।
লড়াইয়ের প্রথম ধাপ
হুগলিতে এসে গীতার পরিচয় হয় শ্রীরামপুর সেবা কেন্দ্রের কর্মী সিদাম সাহার সঙ্গে। তিনি অনুপের চোখের চিকিৎসার জন্য অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশা শেষ হয়ে যায়। তখন তিনি অনুপকে উত্তরপাড়া ব্লাইন্ড স্কুলে ভর্তি করান। সেখান থেকেই অনুপের নতুন যাত্রা শুরু। অষ্টম শ্রেণি পাস করার পর তিনি ভর্তি হন ক্যালকাটা ব্লাইন্ড স্কুলে। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। এরপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অর্জন করেন এবং স্নাতক সম্পন্ন করেন।
নতুন স্বপ্নের পথে এগিয়ে চলা
পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে মাস্টার্স শেষ করার পর এখন অনুপ প্রস্তুতি নিচ্ছেন জুনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ (GRF) পরীক্ষার। তিনি ইতিমধ্যে ২০২৪ সালের নেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। ভারতীয় বিদেশনীতি নিয়ে গবেষণা করতে চান তিনি। তাঁর লক্ষ্য অধ্যাপক হওয়া।
পড়াশোনার জন্য অনুপ প্রযুক্তিকে সঙ্গী করেছেন। ২৩৮ পাতার বই পেনড্রাইভে লোড করে, রেকর্ডিং মেশিন এবং অ্যাপ ব্যবহার করে তিনি জ্ঞান অর্জন করেন। ইউটিউবের সাহায্যও নেন। তাঁর এই যাত্রায় পাশে রয়েছেন মা, সিদাম সাহা, এবং তাঁর বন্ধুরা।
মা ও সন্তানের গল্প
অনুপের মা গীতা বলেন, “ছেলেকে মানুষ করতে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। রান্নার কাজ করে ওর জন্য টাকা জোগাড় করেছি। ঋণ নিয়েছি, কিন্তু ওর ভবিষ্যতের জন্য সব করতে পারি। আমার অনুপ আমাকে গর্বিত করেছে।”
সবার জন্য অনুপ্রেরণা
সিদাম সাহা বলেন, “অনুপের চোখের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারিনি, এটাই আমার আক্ষেপ। কিন্তু ওর পড়াশোনার প্রতি নিষ্ঠা দেখে আমি জানি, একদিন সে বড় কিছু করবে।”
অনুপের জীবন প্রমাণ করে, দৃষ্টিশক্তি না থাকলেও মানসিক শক্তি থাকলে সব বাধা পেরোনো যায়। তাঁর লড়াই, অধ্যবসায়, এবং সফলতার কাহিনি সবার জন্য এক অনুপ্রেরণা।
অন্ধকারকে জয় করে, অনুপ আজ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মনে। তাঁর যাত্রা আমাদের শেখায়, প্রতিকূলতা যত বড়ই হোক, ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তা জয় করা সম্ভব।