শীতের ভোরে বাগনানের সরু গলিগুলোতে ছেলেটিকে হাঁটুতে ভর দিয়ে এগোতে দেখা যেত। দুই পা অকেজো, কিন্তু চোখ দু’টি স্বপ্নে ভরা। সে ছিল বুবাই বাগ। তার প্রতিদিনের লড়াই শুধু নিজের প্রতিবন্ধকতা নয়, ছিল দারিদ্র্যের সাথে। বাবা ছিলেন দিনমজুর, মা কাজ করতেন কলম তৈরির কারখানায়। সংসারের চাপ ও শারীরিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বুবাইয়ের মন কখনো থেমে থাকেনি।
প্রতিদিন ৩০ কিলোমিটার দূরে উলুবেড়িয়ার জগৎপুর আনন্দ ভবন প্রতিবন্ধী আবাসিক বিদ্যালয়ে যাওয়া ছিল তার দিনের শুরু। গলির ছেলেমেয়েরা যখন দৌড়ে স্কুলে যেত, বুবাই হাঁটুতে ভর করে ধুলোমাখা পথ পাড়ি দিত। কেউ কেউ তাচ্ছিল্য করত, কেউ করুণা। কিন্তু বুবাই শিখেছিল এক কথা— নিজেকে কখনো দুর্বল ভাববে না।
প্রথম জাগরণ
বিদ্যালয়ের শিক্ষক অজয় দাস প্রথম বুঝতে পারেন, এই ছেলেটির চোখে এক অন্য জেদ। একদিন তিনি বলেন, “তোমার সীমাবদ্ধতা তোমার শক্তি হয়ে উঠবে, যদি তুমি হাল না ছাড়ো।” বুবাই সেই কথাগুলো সারা জীবনের সঙ্গী করেছিল।
স্কুলের পড়া শেষ করে বুবাই ভর্তি হলো কলেজে। অর্থের অভাবে মাঝে মাঝে পড়াশোনা থেমে যাওয়ার উপক্রম হতো। কিন্তু কখনো সহপাঠীদের সাহায্যে, কখনো শিক্ষকদের দয়ায় সে এগিয়ে গেল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর মনে হলো, তার জীবনের প্রথম স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে।
গবেষণা ও সংগ্রামের গল্প
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বুবাই খেয়াল করল, বাংলায় প্রতিবন্ধী মানুষদের জীবনের ওপর তেমন কোনো বই নেই। এই শূন্যতা তার মনকে নাড়া দিল। শুরু করল গবেষণা। অভাবের সংসার, বন্ধুরা যে যার জীবনে ব্যস্ত, কিন্তু বুবাই একাই লেগে রইল। প্রতিদিন লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে প্রতিবন্ধী মানুষদের ইতিহাস, তাদের সংগ্রাম, এবং সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে ১৪ বছরের চেষ্টায় লিখল এক অনন্য গ্রন্থ— “প্রতিবন্ধী মানুষ রাষ্ট্রে সমাজে ও ইতিহাসে”।
গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর, শুধু তার নিজের কলেজেই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নাম ছড়িয়ে পড়ল। বিভিন্ন সেমিনারে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। তিনি দেখালেন, একটি প্রতিবন্ধক দেহের মধ্যে কত বিশাল স্বপ্ন থাকতে পারে।
সমাজসেবায় নতুন পথ
নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুবাই বুঝেছিল, শুধু নিজের উন্নতি নয়, অন্য বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষদের জীবনেও আলোর দিশা নিয়ে আসা তার দায়িত্ব। তিনি গড়লেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সংগঠনটি দুঃস্থ ও প্রতিবন্ধী মানুষদের পাশে দাঁড়ায়, তাদের শিক্ষা এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
পুরস্কার এবং প্রেরণা
এ বছর, ‘বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস’-এর প্রাক্কালে রাজ্য সমাজকল্যাণ দফতর বুবাই বাগকে ‘আউটস্ট্যান্ডিং ক্রিয়েটিভ অ্যাডাল্ট’ হিসাবে সম্মানিত করে। পুরস্কার তুলে দেন সচিব সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ। এই স্বীকৃতি শুধু বুবাইয়ের ব্যক্তিগত জয় নয়, তার মতো লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য এক উদাহরণ।
শেষ কথা
বুবাই আজ বাগনান কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। তার জীবনের প্রতিটি দিন প্রমাণ করে যে শারীরিক সীমাবদ্ধতা কখনো স্বপ্নকে আটকাতে পারে না। তার কথায়, “অক্ষমতাকে বাধা নয়, সুযোগ ভাবুন। যে যত বাধা পার করতে জানে, সে তত উঁচুতে উঠতে পারে।”
বুবাই বাগের জীবন একটাই বার্তা দেয়— অদম্য ইচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমের কাছে সমস্ত সীমাবদ্ধতা হার মানে।
বিঃ দ্রঃ – হাওড়ার বাগনানের বুবাই বাগের জীবনে পথ চলার কাহিনী অবলম্বনে লিখিত।
|| সমাপ্ত ||
________