ডোমজুড়ের কাটলিয়ার এক সকালে সবকিছু যেন তছনছ হয়ে গেল নাসিরা বেগমের পরিবারের। মা হওয়ার আনন্দকে ছাপিয়ে গেলো এক অপার বিভ্রান্তি, ক্ষোভ আর যন্ত্রণার কাহিনী।
সকাল ৮টা। অঙ্কুরহাটির গলিপথে টুকটুকে লাল অটো এসে থামে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন ৩০ বছরের নাসিরা, সাথে তার স্বামী রাশিদ। ছয় মাস ধরে অপেক্ষা করা দিনটি এসে গেছে। রাশিদ তার স্ত্রীর চোখে ভয় দেখছিল, কিন্তু আশাও ছিল। “দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে,” বলেছিলেন তিনি।
ডোমজুড়ের সেই নার্সিংহোমের গেটের বাইরে ছিল ছোটখাটো একটা ভিড়। নাসিরাকে ধীরে ধীরে স্ট্রেচারে করে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। সিজার হবে, জানতেন পরিবারের সবাই। কিন্তু কে জানত, এই দিনটিই তাদের জীবনের দিক বদলে দেবে?
নাসিরার সিজার শুরু হয় সকাল সাড়ে ৯টায়। অপারেশন থিয়েটারের আলো, ডাক্তার অন্তরা দাসের সতর্ক নির্দেশ, নার্সদের তৎপরতা—সবকিছু যেন সিনেমার মতো চলছিল। কিন্তু মাঝপথে বদলে গেল গল্প।
ডাক্তার অন্তরা দাসের মনে হলো, পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর। নাসিরার জরায়ু থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল অনবরত। শিশুকে বাঁচানো সম্ভব, কিন্তু মাকে? ডাক্তার জানতেন, জরায়ু না কেটে বাদ দিলে নাসিরার প্রাণসংশয় হবে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া? পরিবারের অনুমতি প্রয়োজন।
“রাশিদ!” এক নার্স দ্রুত অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে ডাকলেন নাসিরার স্বামীকে। রাশিদের সামনে তখন দুই পথ—স্ত্রীর জীবন রক্ষা, অথবা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কয়েক মুহূর্তের স্তব্ধতা। তারপরে তিনি কাঁপা হাতে একটি কাগজে স্বাক্ষর করেন।
অপারেশন সফল হয়। শিশুর কান্নায় ভরে ওঠে অপারেশন থিয়েটার। কিন্তু নাসিরা যখন জ্ঞান ফিরে পেলেন, খবরটি তার কানে গেলো—জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর কখনও তিনি মা হতে পারবেন না।
পরিবারের ক্ষোভ
ঘটনার পরপরই নার্সিংহোমের করিডোরে জমা হলো নাসিরার আত্মীয়স্বজন। “আমাদের কিছু বলা হলো না কেন? কেন একা রাশিদকে ডেকে নেওয়া হলো?” চিৎকারে ফেটে পড়লেন নাসিরার বড় ভাই শেখ সফিউল।
রাশিদ তখনও স্তব্ধ। “আমার কাছে আর কোনো পথ ছিল না,” বললেন তিনি, কিন্তু তার কথা যেন কানে যায়নি কারও। নার্সিংহোমের বাইরে গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। স্থানীয়রা যোগ দেয়। ডাক্তার অন্তরা দাসের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ। নার্সিংহোমের জানলায় পাথর ছোঁড়া হয়।
ডাক্তারের যুক্তি
ডাক্তার অন্তরা দাস ধৈর্য ধরে পুরো ঘটনা বোঝানোর চেষ্টা করলেন। “রক্তক্ষরণ এত বেশি ছিল যে জরায়ু না কেটে বাদ দিলে নাসিরার বাঁচার সম্ভাবনা ছিল না। রাশিদের থেকে লিখিত অনুমতি নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়,” বললেন তিনি।
তবু বিক্ষোভ থামছিল না। নাসিরার ভাই সরাসরি বললেন, “আমরা চাই আমাদের বোনের জন্য সুবিচার। ডাক্তার যা করেছেন, তা অন্যায়।”
একটি প্রশ্ন, দুটি জীবন
নার্সিংহোমের একটি কক্ষে তখন নাসিরা বিছানায় শুয়ে। পাশে বসে আছেন রাশিদ, তার কোলে তাদের সদ্যোজাত সন্তান। “তুমি ঠিক করেছ,” বললেন নাসিরা, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল গভীর বিষাদ। রাশিদ তার স্ত্রীকে স্পর্শ করে বললেন, “তোমার জীবন আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সন্তান আমাদের সব সুখ এনে দেবে।”
কিন্তু নাসিরার মনে প্রশ্ন থেকে গেল। মা হওয়া তার জীবনের একটি বড় অংশ ছিল, যা সে হারাল। আরেকটি সন্তান যদি সে চাইত? এই সিদ্ধান্ত কি শুধুই তার ছিল, না কি অন্যের হাতে চলে গিয়েছিল তার অধিকার?
পরিণতি
রাশিদ আর নাসিরার মধ্যে সেই দিন থেকেই একটি দূরত্ব তৈরি হলো। তাদের জীবনে সন্তান হাসি নিয়ে এলেও, সেই হাসি কিছু পুরনো প্রশ্নকে ঢাকতে পারল না।
ডোমজুড়ের ঘটনাটি হয়তো কালের সঙ্গে মুছে যাবে, কিন্তু নাসিরার জীবনের এই পরিবর্তন তার কাছে চিরকালীন। জরায়ু কাটা, শুধু একটি শারীরিক পরিবর্তন নয়, বরং তার অস্তিত্বের এক অংশের হারিয়ে যাওয়া।
প্রতিটি সিদ্ধান্তের পিছনে গল্প থাকে। নাসিরা আর রাশিদের গল্প সেই সত্যকে প্রশ্ন করে—জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত কি সত্যিই ব্যক্তির, নাকি পরিস্থিতির চাপ আর সামাজিক কাঠামো সেটি ঠিক করে দেয়?
|| সমাপ্ত ||
________