মহেশতলার বাটামোড়ের এসবিআই ব্রাঞ্চ। প্রতিদিনের মতোই শুক্রবার সকালটা শুরু হয়েছিল নিরাপত্তারক্ষী প্রকাশ সিংয়ের জন্য। কিন্তু যখন তিনি শাটার খুলে ভেতরে ঢোকেন, তাঁর চোখে ধাক্কা লাগে। ভল্টের দরজা খোলা। সবকিছু এলোমেলো। আর টেবিলের ওপর ছড়ানো পড়ে আছে কিছু খালি কাগজ আর বাক্স।
“ডাকাতি!” হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচিয়ে ওঠেন প্রকাশ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়ে, এবং পুলিশ এসে উপস্থিত হয়।
অভ্যন্তরের চক্রান্ত
তদন্তের দায়িত্বে থাকা অফিসার রঞ্জিত বসু প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিলেন, এটা কোনও সাধারণ ডাকাতি নয়। ভল্টের তালা ভাঙা হয়নি; খুলে ঢোকা হয়েছে। এমন নিখুঁত পরিকল্পনা করার জন্য ভেতরের কারও সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
“চাবির নকল তৈরি করা হয়েছে,” রঞ্জিত নিজের সহকর্মীদের বললেন। “তবে সেটাই বড় প্রশ্ন—কীভাবে?”
ব্যাঙ্কের কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। সবাই একে অপরের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাতে লাগল। কিন্তু যাকে নিয়ে সন্দেহ সবচেয়ে বেশি দানা বাঁধল, সে আরিফ হুসেন।
আরিফের পরিকল্পনা
আরিফ হুসেন একসময় ব্যাঙ্কের নন-ব্যাঙ্কিং স্টাফ ছিল। কিন্তু তাঁর চাকরি চলে যায়। চাকরির ক্ষতি শুধু তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর আঘাত করেনি, তাঁর মানসিক অবস্থাকেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। আরিফের মনে ছিল প্রচণ্ড ক্ষোভ। এই চাকরি তাঁকে শুধু জীবিকার নিরাপত্তা দিয়েছিল না, দিয়েছিল মর্যাদা। সেটাই তিনি হারিয়েছিলেন।
এই ক্ষোভ থেকেই জন্ম নেয় এক ভয়ংকর পরিকল্পনা। আরিফ জানতেন ব্যাঙ্কের প্রতিটি খুঁটিনাটি—ভল্টের অবস্থান, তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, এমনকি তালার গোপন ডিটেলস।
দুই মাস আগে, যখন তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়, তখন থেকেই তিনি পরিকল্পনা শুরু করেন। স্ত্রী রুবিনা এবং ভাই সায়েফকে এই অপারেশনে সঙ্গী করেন।
“তোমাদের সাহায্য ছাড়া এটা সম্ভব নয়,” আরিফ বলেছিলেন।
রুবিনা আর সায়েফ রাজি হয়। আরিফ ব্যাঙ্কের এক পুরোনো চাবি নকল করেন। তারপরই আসে সুযোগ। শুক্রবার ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার পর দুই দিনের ছুটি।
অপারেশন ‘গোল্ডেন ক্লিফ’
শুক্রবার রাতে, আরিফ এবং তাঁর সঙ্গীরা চুপিসারে ব্যাঙ্কে ঢোকেন। তালা খোলার শব্দ যাতে বাইরের কেউ না শুনতে পায়, তার জন্য তাঁরা গাড়ির শব্দে ঢেকে দেন। একে একে সোনার বাক্সগুলো ভল্ট থেকে বের করা হয়। ক্যাশ বাক্স ভরে নেওয়া হয় ব্যাগে।
অপারেশন শেষ করতে রাতভর লেগে যায়। ভোর হতেই তাঁরা উলুবেড়িয়ার দিকে পালিয়ে যান। তিন কোটি টাকার সোনা এবং ৭৫ লক্ষ টাকা নিয়ে তাঁরা পরিকল্পনা করছিলেন অজ্ঞাতস্থানে আত্মগোপন করার।
পুলিশের জাল
কিন্তু আরিফ ভুল করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তাঁর পরিচিতি পুলিশ জানতে পারবে না। কিন্তু পুলিশের সন্দেহ প্রথম থেকেই ছিল ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্মীদের ওপর।
তদন্তের সময়, আরিফের একটি পুরোনো কল রেকর্ড পুলিশের হাতে আসে। সেখানে রুবিনার সঙ্গে তাঁর কথোপকথনে একটি বাক্য ছিল, যা পুলিশকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সাহায্য করে:
“সব তৈরি হয়ে গেছে। ছুটির দিনেই কাজ শেষ করব।”
রবিবার সকালে, উলুবেড়িয়ার একটি বাড়ি থেকে আরিফ এবং তাঁর দলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সোনা এবং টাকাও উদ্ধার হয়।
শেষ কথা
পুলিশ যখন আরিফকে ব্রাঞ্চে নিয়ে গিয়ে পুনর্গঠন করল, তখন তিনি শান্ত গলায় বললেন, “আমার কোনও আফসোস নেই। আমি স্রেফ নিজের সম্মান ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হয়তো আমার কপালে ছিল না।”
তাঁর কথায় ছিল এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা। কিন্তু অফিসার রঞ্জিত জানতেন, এমন অপরাধ কখনও মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে পারে না।
স্টেশনের লকআপে বসে আরিফ ভাবছিলেন, প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে গিয়ে তিনি যা হারিয়েছেন, তা কখনও আর ফিরে পাওয়া যাবে না।
বিঃদ্রঃ – মহেশতলায় এসবিআই-এর ব্রাঞ্চের ঘটনা অবলম্বনে লিখিত।
|| সমাপ্ত ||
________