শীতের রাত। চারপাশ নিস্তব্ধ, যেন ঘুমিয়ে পড়েছে গোটা গ্রাম। আউশগ্রামের দেয়াশা গ্রাম তখন কালীপুজোর জাঁকজমকে মগ্ন। চারিদিকে আলো ঝলমলে, পুজোর মন্ত্রধ্বনি, ঢাকের শব্দ। তবে এই আনন্দের আড়ালে, কিছু অচেনা চোখ পর্যবেক্ষণ করছিল সমস্ত কিছু। এসব ছিল “বানজারা” দল, যারা বহুদিন ধরেই পরিকল্পনা করছিল এই এলাকায় চুরি করার জন্য। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কালী মন্দিরের লক্ষাধিক টাকার অলঙ্কার চুরি করা।
পরের রাত, রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের চারপাশের আলো নিভে যায়। বানজারা দলের তিন সদস্য ধীরে ধীরে মন্দিরের দিকে এগিয়ে আসে। চারিদিকে কোনো শব্দ নেই। তারা আস্তে আস্তে মন্দিরের গেটের তালা ভাঙে। তারপর মন্দিরের দ্বিতীয় গেটেও ঠিক একই কায়দায় তালা ভাঙে এবং প্রবেশ করে।
ভেতরে প্রবেশ করার পর, বিক্রমের চোখ পড়ে কালীমূর্তির গলায় থাকা সোনার হার এবং মূর্তির মাথায় থাকা রূপার মুকুটের ওপর। সে তার হাত বাড়ায়, আর ঠিক তখনই হঠাৎ যেন একটা শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে। বিক্রম একটু পিছিয়ে আসে, কিন্তু তারপর তার সাহস বেড়ে যায়। অলঙ্কারগুলো খুলে ফেলে দ্রুত সেগুলো নিয়ে পালিয়ে যায় তারা।
পরের দিন সকালে, মন্দিরের পুরোহিত রামেশ্বর পুজোর জন্য এসে দেখেন মন্দিরের গেট ভাঙা। মূর্তির অলঙ্কার নেই। গ্রামের মানুষকে ডেকে খবর দেওয়া হয়। পুরো গ্রাম স্তম্ভিত, কালী মন্দিরে এমন চুরি কেউ ভাবতেই পারেনি। কয়েক ঘণ্টা পর, পাশের ব্রজপুর গ্রামের কালী মন্দির থেকেও ঠিক একই ধরনের চুরির খবর আসে।
দুইদিন পর, ভাতারের আমারুন বাজারের শিব মন্দির এবং এওড়া গ্রামের নারায়ণ মন্দিরে একই কায়দায় চুরি ঘটে। সবার মনেই প্রশ্ন, কে এই চোরেরা? পুলিশের সন্দেহ দ্রুত “বানজারা” দলের ওপর পড়ে। বানজারা দল এমন একটি চক্র যারা বহু গ্রামে চুরি করার জন্য পরিচিত।
পুলিশ তদন্তে নেমে জানতে পারে যে, এই চুরির কিছুদিন আগেই কয়েকজন অচেনা লোককে বিভিন্ন মন্দিরের আশপাশে ঘুরতে দেখা গিয়েছিল। স্থানীয়রা জানায়, তাদের আচরণ বেশ অদ্ভুত ছিল এবং তারা অনেকটা মন্দিরের দিকেই তাকিয়ে থাকত। এটা সন্দেহজনক হলেও তখন কেউ গুরুত্ব দেয়নি।
পুলিশ গ্রামবাসীদের জানায়, বানজারা দলের সদস্যরা সাধারণত নিজেদের কার্যপদ্ধতি সম্পর্কে অনেক সতর্ক থাকে। চুরির আগে তারা সেই এলাকায় ঘুরে ঘুরে পর্যবেক্ষণ করে, মন্দিরে কী কী মূল্যবান জিনিস আছে তার খবর রাখে, এবং তারপর হঠাৎ রাতের অন্ধকারে চুরির পরিকল্পনা করে।
গ্রামের লোকেরা এখন অত্যন্ত আতঙ্কিত। তারা নিজেদের মন্দিরের সামনে পাহারা দেওয়া শুরু করে। কিন্তু বানজারা দল অনেক চালাক। তারা নতুন পরিকল্পনা করতে শুরু করে, যাতে তাদের ধরা না পড়তে হয়। রাতের অন্ধকারে, তারা বিভিন্ন গ্রামে নতুন করে নজরদারি চালায়, যাতে পরবর্তী চুরির পরিকল্পনা সফল হয়।
পুলিশও এদিকে বানজারা দলের বিরুদ্ধে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। গোপনে বিভিন্ন লোক লাগিয়ে দলটির গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে শুরু করে। কিন্তু এই চোরদের চালাকি এত বেশি যে, পুলিশ তাদের সঠিকভাবে ধরতে পারছে না।
এক সপ্তাহ পরে, গ্রামের এক কৃষক জানায়, সে রাতের অন্ধকারে কয়েকজন লোককে মন্দিরের কাছে ঘুরতে দেখেছে। এই খবর শুনে পুলিশ সেখানে ফাঁদ পেতে বানজারা দলের একজনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু ধরা পড়ার পরেও সেই সদস্য কিছুই স্বীকার করে না। সে জানায়, তারা কোনো চুরি করেনি; তারা স্রেফ মন্দিরের সেবা করার উদ্দেশ্য নিয়ে সেখানে ছিল।
আসলে বানজারা দল অত্যন্ত চতুর। তারা নিজেদের সঠিক পরিচয় আড়ালে রেখে ছদ্মবেশে আসে এবং স্থানীয়দের বিশ্বাস অর্জন করার চেষ্টা করে। কিন্তু পুলিশের চাপের মুখে বানজারা দলের সদস্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ে এবং সমস্ত পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। সে পুলিশকে জানায়, পুরো ঘটনাটি তাদের নেতা বিক্রমের নির্দেশে ঘটানো হয়েছে।
গ্রামবাসীরা শুনে আতঙ্কিত, কারণ তাদের প্রিয় মন্দিরগুলো থেকে মূল্যবান অলঙ্কার এমনভাবে হারিয়ে গেছে যা কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। বানজারা দলের এমন সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা দেখে গ্রামবাসীরা হতবাক হয়ে যায়।
অবশেষে পুলিশ বানজারা দলের আরো কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে এবং অলঙ্কারের একটি বড় অংশ উদ্ধার করে। কিন্তু পুরো অলঙ্কার আর ফিরে পাওয়া সম্ভব হয়নি। গ্রামবাসীরা তাদের মন্দিরের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য নতুন করে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পুলিশের পক্ষ থেকেও আশ্বাস দেওয়া হয় যে, এমন ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ধীরে ধীরে গ্রামটি আবার আগের মতো শান্ত হয়ে আসে, কিন্তু মানুষদের মনে সেই ভয় এবং সন্দেহ রয়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত, এই চুরির ঘটনাটি যেন গ্রামের মানুষের মধ্যে একটি সতর্কতার বার্তা হয়ে থেকে যায়, যাতে ভবিষ্যতে এমন দুর্দিনের সম্মুখীন হতে না হয়।
|| সমাপ্ত ||
________