কলকাতার বুকে চিরচেনা এন্টালি থানা এলাকার ২৩ নম্বর কনভেন্ট রোড। বহু বছর ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পরিত্যক্ত অ্যাসিড কারখানাটি যেন এক নীরব অভিশাপ। মালিক পক্ষের শরিকি সমস্যা আর প্রশাসনের উদাসীনতার কারণে জায়গাটি দিনের পর দিন পরিণত হয়েছিল অবৈধ কার্যকলাপের আখড়ায়।
রবিবার রাত সাড়ে আটটা। নিঝুম রাস্তায় তখন মাঝেমধ্যে কয়েকটি গাড়ির হর্ন ভেসে আসছিল। কারখানার ভিতরে ডিউটি করছিলেন দুই ভাই, কারখানার নিরাপত্তারক্ষী। বড় ভাই রঘু, বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ছোট ভাই লক্ষ্মণ, বছর ত্রিশের যুবক। অভাবের সংসারে এই চাকরিটাই ছিল তাঁদের একমাত্র ভরসা।
ধ্বংসের শুরু
সেদিনও কাজ শেষে চা খাচ্ছিলেন রঘু। হঠাৎ একটা বিকট শব্দ! মাটি যেন কেঁপে উঠল। ছুটে গিয়ে দেখলেন, কারখানার একাংশ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে। ধুলো আর কংক্রিটের স্তুপের নিচে চাপা পড়ল বেশ কয়েকটি পুরনো মেশিন। রঘু এক পা এগোতে না এগোতেই স্তুপের একটা বড় অংশ তাঁর উপর ভেঙে পড়ে।
লক্ষ্মণ চিৎকার করতে করতে দৌড়ে এলেন। “দাদা! দাদা!”
ভাইয়ের দিকে ছুটে গিয়ে স্তুপের টুকরো সরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন তিনি। কিন্তু আরও একটা কংক্রিটের অংশ ভেঙে পড়ল। এবার চাপা পড়লেন তিনিও।
গোলমালের আঁচ
ঘটনার খবর মুহূর্তেই পৌঁছে যায় স্থানীয়দের কাছে। এলাকায় চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। রাস্তায় ভিড় বাড়তে থাকে। কেউ একজন থানায় খবর দেয়। পুলিশের সঙ্গে পুরসভার উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। বিশাল আলো আর ক্রেন নিয়ে শুরু হয় ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজ। মেয়র আর স্থানীয় কাউন্সিলরও আসেন। কিন্তু সেই সময় পর্যন্ত রঘু ও লক্ষ্মণকে স্তুপ থেকে বের করা সম্ভব হয়নি।
এক মর্মান্তিক প্রাপ্তি
দুই ঘণ্টার টানা চেষ্টার পর, উদ্ধারকারী দল স্তুপের নিচ থেকে দুই ভাইকে বের করতে সক্ষম হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসকরা তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। এলাকাজুড়ে কান্নার রোল।
রঘু আর লক্ষ্মণের পরিবারের আর্তনাদ যেন চিৎকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তাঁদের মা, এক বৃদ্ধা মহিলা, কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার ছেলেরা এই পরিত্যক্ত মৃত্যুপুরীতে জীবন শেষ করল। কিসের জন্য?”
গোপন সত্য ফাঁস
এই ঘটনার পর কারখানাটি নিয়ে স্থানীয়রা মুখ খুলতে শুরু করে। জানা গেল, দীর্ঘদিন ধরে এই কারখানাটি নেশাগ্রস্তদের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। একাধিকবার দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এলাকাবাসীরা বলছেন, “আজ দু’জন মারা গেছে। কাল যদি আমরা মারা যাই, তার দায় কে নেবে?”
এক স্থানীয় যুবক জানাল, “আমরা বহুবার প্রশাসনকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কারখানার মালিকপক্ষের প্রভাব এতটাই বেশি যে কেউ কিছু করার সাহস পায় না।”
মৃত্যুর নিচে লুকিয়ে থাকা প্রশ্ন
রঘু আর লক্ষ্মণের মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়। এটি প্রশাসনের উদাসীনতা, মালিকপক্ষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, এবং সমাজের নীরবতার এক কালো দলিল। কারখানাটি যদি এত দিন ধরে পরিত্যক্ত ছিল, তবে কেন তা ভেঙে ফেলা হয়নি? কারা এর ভিতরে নেশার ঠেক চালাচ্ছিল?
স্থানীয়রা এখন একত্র হয়েছে। তাঁরা দাবি তুলেছেন, অবিলম্বে এই কারখানার ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে তা সুরক্ষিত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই দাবি কি শুনবে প্রশাসন? নাকি রঘু আর লক্ষ্মণের মতো আরও জীবন এই পরিত্যক্ত শ্মশানের নিচে চাপা পড়বে?
শেষ কথা
কনভেন্ট রোডের সেই পরিত্যক্ত অ্যাসিড কারখানা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যেন এক ভয়াল স্মৃতিস্তম্ভ। আর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা প্রশ্নগুলো আজও উত্তর খুঁজছে।
|| সমাপ্ত ||
________