পুটিমারি গ্রামের বাণী নিকেতন শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের সকালটা ছিল অন্য দিনগুলোর মতোই। মাঠে বাচ্চাদের কচি কণ্ঠের হইচই, ক্লাসরুমে বইয়ের পাতার মৃদু শব্দ। কিন্তু সেই শান্ত পরিবেশে আচমকাই যেন কালবৈশাখীর ঝড় নামল।
শুরুটা
স্কুলের শিক্ষিকা অনিতা রায় অধিকারী ছোট্ট স্টাফরুমে বসে চা খেতে খেতে খেয়াল করলেন তাঁর মানিব্যাগের চেইন খোলা। দ্রুত ব্যাগটা খুলে দেখলেন টাকা নেই। তাঁর মায়ের চিকিৎসার জন্য আনা হাজার দেড়েক টাকা হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রথমে তিনি ভাবলেন, হয়তো ভুল করে অন্য কোথাও রেখেছেন। কিন্তু একে একে সব খুঁজেও কিছু পেলেন না। রাগ আর হতাশায় তাঁর মন উথালপাথাল। কারও সাহস হবে তাঁর ব্যাগ থেকে টাকা চুরির? সেই চিন্তায় মনের মধ্যে সন্দেহের অন্ধকার গর্জন তুলতে লাগল।
সন্দেহের অঙ্গুলি
হঠাৎ তাঁর মনে হলো, স্কুলের বাচ্চাদের কেউ হয়তো কৌতূহলবশত ব্যাগ হাতড়েছে। মিড ডে মিলের রাঁধুনিদের ডেকে নিয়ে আসা হলো। তাদের সাহায্যে শিক্ষিকা সিদ্ধান্ত নিলেন বাচ্চাদের তল্লাশি করা হবে।
সকালে ক্লাস চলছিল যখন, বাচ্চারা একে একে ক্লাস থেকে ডেকে নেওয়া হলো। প্রথমে তাদের পকেট তল্লাশি হলো। তারপর এক অদ্ভুত নিষ্ঠুরতা ছড়িয়ে পড়ল—বাচ্চাদের জামা-কাপড় খুলে দেখা হলো। একের পর এক শিশুরা বিবস্ত্র অবস্থায় কেঁদে উঠল, কিন্তু শিক্ষিকার দৃষ্টি তখন অন্ধকারে বাঁচার শেষ চেষ্টার মতো দৃঢ়।
নির্মম মুহূর্ত
তল্লাশির পরে কিছুই পাওয়া গেল না। কিন্তু ততক্ষণে শিক্ষিকা তাঁর রাগ সামলাতে না পেরে দুটি বাচ্চাকে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করলেন। একদিকে শিশুরা কাঁদছিল, অন্যদিকে তাদের চোখে ভয় আর লজ্জার গভীর ছায়া। ক্লাসরুমের জানালার বাইরে থেকে দেখছিল বাকিরা। সেই ভয় আর দুঃস্বপ্নের কথা তারা ঠিক সেদিনই বাড়ি গিয়ে তাদের বাবা-মায়েদের জানালো।
বিক্ষোভের আগুন
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। স্কুলের গেটের সামনে ভিড় জমতে শুরু করল। ক্ষুব্ধ অভিভাবকরা হাতে লাঠি আর মুখে স্লোগান নিয়ে স্কুলে ঢুকে পড়লেন।
“আমাদের বাচ্চাদের ওপর এমন অত্যাচার কেন?”
“এত ছোট ছোট বাচ্চাদের এভাবে বিবস্ত্র করলেন কীভাবে?”
তাদের রাগ গড়াতে লাগল উত্তপ্ত কথায়। কেউ কেউ স্কুলের দরজায় তালা ঝুলিয়ে দিল।
শিক্ষিকা অনিতা রায় অধিকারী সেই সময় স্কুলের স্টাফরুমে বসেছিলেন। বাইরে অভিভাবকদের চিৎকার আর দরজা কাঁপানোর আওয়াজে তাঁর মনে হলো, একদল মানুষ যেন প্রতিশোধ নিতে আসছে। তিনি কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে বেরিয়ে এলেন।
“আমার টাকা খোয়া গেছে, তাই এটা করতে বাধ্য হয়েছি!”—তাঁর কথায় অভিভাবকদের রাগ যেন আরও উসকে গেল।
পরিণতি
ঘটনার পর দিনহাটা শিক্ষা দপ্তর থেকে তদন্ত শুরু হলো। এডুকেশন অফিসার স্কুলে এসে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বললেন। তাদের চোখে তখনও আতঙ্ক। শিশুরা জানালো, কীভাবে তাদের নিগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তের রিপোর্টে এডুকেশন অফিসার বললেন,
“শিক্ষিকার এমন আচরণ একেবারে অগ্রহণযোগ্য। বাচ্চাদের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন শিক্ষার অধিকার আইনের পরিপন্থী।”
শেষে কী হলো?
শিক্ষিকা অনিতা রায় অধিকারীর চাকরি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো। কিন্তু স্কুলের শিশুদের মনে যে গভীর ক্ষত তৈরি হলো, তার দাগ কি কখনও মোছা যাবে?
তাদের ছোট্ট মন যে শিক্ষা পেল, তা মানবিকতার অন্ধকারতম দিক। ওই দিনটার স্মৃতি তাদের মনে সব সময় মনে করিয়ে দেবে, খোয়া যাওয়া টাকার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান একটা জিনিস হারিয়েছিল তারা—নিজেদের নিরাপত্তা।
|| সমাপ্ত ||
________