চাষিরা বলে, “আশায় বাঁচে চাষা”। কিন্তু সেই আশা এবার যেন জলেই ভেসে গেছে। টানা বৃষ্টির পর পূর্ব বর্ধমানের কৃষক সমাজে এখন শুধুই হাহাকার। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আলু চাষের জন্য বীজ বপনের কাজ সারা হয়ে যায়; কোন কোন জমিতে বীজ ফুটে গাছ বড়ও হয়ে ওঠে। আর এবছর সেই আশার ক্ষেতে জল ঢেলে দিল ঘূর্ণিঝড় ‘ডেনা’। জমির পর জমি এখন ভরাট হয়ে আছে বৃষ্টির জলে। তাই কৃষকদের প্রশ্ন, “এবার কি তবে আলু চাষ হবে না?”
শক্তিগড়ের ১৯ নম্বর জাতীয় সড়কের পাশ ঘেঁষে থাকা আলুর ক্ষেতগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এই জমিতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আলু চারা গজাবে। জৌগ্রাম, মশাগ্রাম থেকে শুরু করে বহু ক্ষেতের মাটির ওপরে এখন শুধু জলের ঢেউ। বহু কৃষক এখনও আলুর বীজ বপনই করতে পারেননি। আর যাঁরা পেরেছেন, তাঁরাও শঙ্কিত।
সাধারণত এই সময়ে পোখরাজ প্রজাতির আলুর চাষ করা হয়। কম সময়ে ফলন দেওয়া এই আলু চাষিদের জন্য বড় ভরসা। কিন্তু এবছর সময়মতো সেই চাষ শুরু করতেই পারছেন না তাঁরা। এই আলু চাষ হয় মূলত তাড়াতাড়ি বাজারে ছাড়ার জন্য, যাতে দ্রুত বিক্রির মাধ্যমে আয় হয়। হিমঘরে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে নয়। কিন্তু এবছর সেই চাষের মাটি তৈরি করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে চাষিদের।
পূর্ব বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে আলুর চাষের জমিগুলি এখন ডুবে আছে। এক বিঘে জমিতে আলু চাষ করতে গেলে প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। চাষিরা বলছেন, এই সময়ে সাধারণত ধান কাটা শেষ করে জমি প্রস্তুত করে আলু বীজ বপন করা হয়। তবে এবছর সেই সময়টি পেরিয়েও তারা জমি তৈরি করতে পারছেন না।
বৃষ্টির জল সরে গেলেও মাটি শুকোতে সময় লাগবে। এর মধ্যে আবার বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। জমি প্রস্তুত করার আগেই শীত পেরিয়ে যাবে বলে শঙ্কায় কৃষকরা। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা আর প্রকৃতির অস্থিরতায় তাঁদের রোজকার জীবন যেন এক দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
তবে জেলার কৃষি আধিকারিক কিছুটা আশ্বস্ত করতে চাইলেন। তিনি বললেন, “আলু চাষের ক্ষতির সম্ভাবনা কম। জল নেমে গেলেই জমি শুকিয়ে যাবে, তারপরই আলু চাষ সম্ভব। মাত্র ৬০-৬৫ দিনের মধ্যেই পোখরাজ আলু ফলন দিতে পারে। তাই সময় এখনও রয়েছে।”
চাষিরা যদিও এই আশ্বাসে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁদের মনে শঙ্কা রয়েই গেছে। জমি শুকোতে বেশি সময় লাগলে ফলনে প্রভাব পড়তে পারে। বৃষ্টির জল জমি থেকে দ্রুত সরে না গেলে ফসলের উর্বরতা কমে যেতে পারে। আবার খরচের পরিমাণ বাড়তে পারে।
এই চাষিরা জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাঁদের রোজগারের বড় অংশ আসে এই চাষ থেকে। তাই তাঁরা বৃষ্টি থামার পর জমি শুকানোর অপেক্ষায় দিন কাটাচ্ছেন। বৃষ্টির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কত সময় লাগবে, তা যেন তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কৃষকদের সামনে শুধুই চ্যালেঞ্জ। বৃষ্টি কমলেও মাটির প্রস্তুতি, সেচের সময় এবং ফলনের সময়সীমা নিয়ে তাঁরা চিন্তিত। নতুন করে যে খরচ হবে, তা তাঁরা কিভাবে সামলাবেন, সেটাও বড় প্রশ্ন। কৃষকদের এমন দুরবস্থার সাক্ষী থাকল এই বছরের শুরুর আলু চাষের মৌসুম।
তবু তাঁরা হাল ছাড়ছেন না। সবারই আশায় বাঁচা। জমি শুকিয়ে গেলে আবার তাঁরা চেষ্টা করবেন। বৃষ্টির থাবা তাঁদের চেষ্টাকে দুর্বল করতে পারবে না। এই চাষিরা জানেন, আশাই তাঁদের শক্তি।
|| সমাপ্ত ||
________