ডায়মন্ড হারবার লঞ্চ ঘাটে প্রতিদিনের মতোই ব্যস্ততা ছিল। পা রাখার জায়গা নেই, যাত্রীদের ভিড়ে হকারদের চিৎকার, ছোট বাচ্চাদের কান্না—সব মিলিয়ে সেই চিরচেনা দৃশ্য। বিকেলের দিকে পৌনে পাঁচটার লঞ্চ ছাড়ার আগে গুঞ্জন একটু কমে এসেছিল। মানুষজন জায়গা নিয়েছে, কেউ ফোনে কথা বলছে, কেউ চুপচাপ নদীর দৃশ্য দেখছে।
তবে একজন, বছর তিরিশের এক যুবক, বাকি যাত্রীদের থেকে খানিক আলাদা। তার চোখে অস্বাভাবিক একটা খেলা। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বারবার কিছু বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু করছে না। তার অস্থিরতা আশেপাশের কয়েকজনের চোখে পড়ছিল।
“দাদা, কোনো সমস্যা?” পাশের একজন তাকে জিজ্ঞেস করলেন।
যুবক হেসে বলল, “না, সব ঠিক আছে।” কিন্তু তার গলার স্বর যেন কোনো গভীর চিন্তার ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
লঞ্চ ছাড়ল। গন্তব্য কুঁকড়াহাটি। নদীর উপর দিয়ে হাওয়া বইছে, সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। এমন সময় ওই যুবক আচমকা উঠে দাঁড়াল। লঞ্চের রেলিং ধরে বাইরে তাকাল। তার আচরণ এতটাই অদ্ভুত ছিল যে অন্য যাত্রীরা তাকিয়ে রইলেন। একজন মহিলা বললেন, “ও তো ঝুঁকির মতো দাঁড়িয়েছে! একটু বলুন কেউ।”
তারপর ঘটে গেল সেই অভাবনীয় ঘটনা। যুবক আচমকা রেলিং টপকে নদীতে ঝাঁপ দিল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে জলের তলায় তলিয়ে গেল। লঞ্চজুড়ে চিৎকার শুরু হলো। “কেউ দেখছে? কে নামবে?” “পুলিশ ডাকুন!” চারদিকে হইচই।
ডায়মন্ড হারবার থানায় খবর দেওয়া হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা উপস্থিত হলেন। শুরু হলো তল্লাশি। কিন্তু নদীর জলের গহীন অন্ধকারে সেই যুবক কোথায় হারিয়ে গেল, তার কোনো চিহ্ন পাওয়া গেল না।
অতীতের ছায়া
ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পুলিশ তার পরিচয় বের করার চেষ্টা করছিল। লঞ্চে ওঠার সময় তার কোনো টিকিট ছিল না, কোনো পরিচয়পত্রও পাওয়া যায়নি। একমাত্র সূত্র ছিল তার পকেটে পাওয়া একটি ছেঁড়া কাগজ। তাতে লেখা ছিল মাত্র কয়েকটি শব্দ:
“তুমি ফিরে এলে, আমায় খুঁজবে কি?”
পুলিশ তার পরিচয় জানার জন্য স্থানীয় থানাগুলিতে তথ্য পাঠালো। সন্ধ্যায়, একজন মাঝি এসে পুলিশকে জানাল, সে নদীর ধারে এই যুবককে গত কয়েকদিন ধরে একা বসে থাকতে দেখেছে। তার কাছে একটি পুরনো ছবি ছিল। ছবিতে ছিল একটি হাসিখুশি পরিবার—যুবক, তার স্ত্রী, আর ছোট্ট একটি মেয়ে।
পরের দিন এক বৃদ্ধা থানায় এসে যুবকের ছবি দেখে তাকে শনাক্ত করলেন। “ও আমার ছেলে সৌরভ। কয়েক মাস আগে ওর মেয়ে নদীতে পড়ে মারা যায়। আর স্ত্রী ওকে ছেড়ে চলে যায়। সেই থেকে ওর মাথার ঠিক ছিল না।” বৃদ্ধার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু যেন যুবকের হারানো জীবনের গল্প বলে যাচ্ছিল।
চিরতরে অন্ধকার
সিভিল ডিফেন্স অনেক খোঁজ করেও সৌরভের দেহ খুঁজে পেল না। সে কি জলে তলিয়ে গেল, নাকি কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেল, কেউ জানে না। তবে লঞ্চের যাত্রীদের কাছে সেই সন্ধ্যা হয়ে রইল জীবনের এক দুঃখভারী অভিজ্ঞতা।
নদীর জল তার অনেক কিছু নিজের ভেতরে টেনে নেয়। কিন্তু তার গোপন কথা নদীর বুকে চিরকাল ঢাকা থাকে। আর সৌরভ? হয়তো সে খুঁজে পেয়েছে সেই শান্তি, যা তার ভাঙা হৃদয়ে এতদিন অনুপস্থিত ছিল।
|| সমাপ্ত ||
________