আকাশ ধীরে ধীরে গাঢ় নীল থেকে গাঢ় কালো রং ধারণ করছে। সন্ধ্যার নরম আলোয় ঝিলমিল করছে নদীর জল, সেই স্রোতের পাশে একা বসে আছে অর্ণব। ৩০ বছরের তরুণ, বেশ ভেবেচিন্তে এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ আজ কিছুই আর ঠিকঠাক মনে হচ্ছে না। ক্লান্ত মনে, বিষন্ন চেহারায় নদীর দিকে তাকিয়ে অর্ণব ভাবছে নিজের জীবন নিয়ে।
অর্ণবের ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল শহরের বড় কোম্পানিতে কাজ করবে। কিন্তু সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে অনেক কিছুই যেন হাতছাড়া হয়ে গেছে। পড়াশোনার চাপ, কাজের চিন্তা, আর মাঝে মাঝে নিজের অস্তিত্বের সংকট নিয়ে সংগ্রাম করে চলেছে সে। ভালো চাকরি পেয়েছে ঠিকই, তবে একরকম যান্ত্রিকতার মধ্যে জীবনটা চলে যাচ্ছে।
নদীর ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসের আলতো স্পর্শ তার মনের অনেক গভীরে থাকা কিছু আবেগকে যেন উস্কে দিল। আজ তার মনে পড়ছে মিথিলার কথা। মিথিলা, তার কলেজের বন্ধু, তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। তারা একসাথে চলার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু অর্ণব কাজের খাতিরে এক শহর থেকে আরেক শহরে ছুটে বেড়াত, মিথিলা তার এই দুরবস্থার কথা বুঝেও কিছু বলত না। একসময় দূরত্বই তাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে দিল।
অর্ণব নিজেই জানে না, মিথিলা কবে যে তার জীবন থেকে সরে গিয়েছিল, শুধু একদিন সে বুঝতে পারল যে তারা আর আগের মতো নেই। মিথিলা তাকে বলেছিল, “তুমি তোমার স্বপ্নের পেছনে ছুটে যাও, আমিও আমার জীবনে স্থিরতা চাই।” সেই শব্দগুলো এখনো কানে বেজে ওঠে, কারণ তারা দুজনই জানত, তাদের চাওয়া দুজনের জীবনের পথ দুটোকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
একসময়, অর্ণব চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণের জন্য নদীর আওয়াজ শুনতে লাগল। এই নদীর মতোই তো সে, যেখানে হাজারও ঢেউ, কিন্তু প্রতিটি ঢেউ যেন একেকটা হারিয়ে যাওয়া মুহূর্তের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখনো তার মধ্যে ভালোবাসা আছে, মিথিলার জন্য একটা টানও আছে। কিন্তু বাস্তবতা তাকে সেই জীবনে ফিরতে দেয় না।
আজ আরেকটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। তার কোম্পানি তাকে বিদেশে কাজের জন্য একটা প্রস্তাব দিয়েছে, যা তার ক্যারিয়ারের জন্য অনেক বড় সুযোগ। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা সে কেন যেন নিতে পারছে না। বিদেশে গেলে তার জীবন আরও দূরে চলে যাবে, হয়তো পরিবার, বন্ধুবান্ধব আর পরিচিত মুখগুলোকে হারাবে চিরদিনের জন্য।
ভাবতে ভাবতে অর্ণবের চোখের কোনায় অশ্রু জমতে শুরু করল। এই কঠিন বাস্তবতা, কঠিন চাওয়া-পাওয়ার হিসাব যেন তার জীবনের সবকিছু নিয়ে এক জটিলতার বোধ তৈরি করেছে।
হঠাৎই তার ফোনে একটি মেসেজ আসে, তার মা মেসেজ করেছে, “তুই কি আজ রাতে বাড়ি ফিরবি না?” অর্ণব ফোনটা এক ঝলক দেখে নদীর জলতে আলতো স্পর্শ দিয়ে মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল। মা তো তার জন্যই অপেক্ষা করছে, আর কিছুই না। এত জটিলতার ভেতরে মায়ের মেসেজটুকুই যেন একটু প্রশান্তির স্রোত এনে দিল।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে অর্ণব উঠে দাঁড়াল। বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এখনো তার জন্য কঠিন, কিন্তু হয়তো কিছু উত্তর সে এই নদীর ধারে পেয়ে গিয়েছে। কিছু ভালোবাসা ছেড়ে গেলে হয়তো চলে যায়, কিন্তু নিজের কাছে থাকা ভালোবাসার অনুভূতিগুলো কখনো ফুরায় না।
|| সমাপ্ত ||