আলু ক্ষেতের অমীমাংসিত রহস্য
সকালটা অন্য দিনের মতোই ছিল। বাঁকুড়ার মধুবনের মাঠে আলু গাছের পাতাগুলো শিশিরে ঝলমল করছিল। কৃষ্ণ সোরেন সেদিনও সূর্য ওঠার আগেই জমিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সারাজীবন ধরে তিনি এই মাটির সঙ্গে মিশে আছেন। নিজের হাতে আলু গাছের যত্ন নিতে নিতে যেন গাছগুলোর সাথেই তার এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
কিন্তু সেদিন কিছু একটা যেন অন্যরকম ছিল। হালকা কুয়াশার ভেতরে জমির এক কোণে কাজ করছিলেন তিনি। হঠাৎই পাশের চাষিরা দেখলেন, কৃষ্ণ হঠাৎই নুয়ে পড়লেন। প্রথমে মনে হয়েছিল হয়তো সাময়িক দুর্বলতা। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কৃষ্ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না, চোখদুটো অদ্ভুতভাবে স্থির হয়ে গিয়েছিল।
ভয় আর তাড়াহুড়ো
সঙ্গে সঙ্গে সবাই মিলে তাকে নিয়ে ছুটলেন গোগড়া গ্রামীণ হাসপাতালে। কেউ কেউ বললেন, হয়তো সাপে কামড়েছে। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই তার শরীর নিথর হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুতেই তাকে বাঁচানো সম্ভব হলো না। মৃত্যুর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষ্ণের পরিবারের উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তার স্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়লেন, আর দুই ছোট ছেলে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল।
গুজবের বন্যা
মধুবনে তার মৃত্যুর খবরে চাষিরা শোকস্তব্ধ হলেও, গুজব ছড়াতে সময় লাগল না। কেউ বলল, “জমিতে বিষাক্ত সাপ ছিল। সেটাই কামড়েছে।” কেউ আবার বলল, “কৃষ্ণের শরীরে কিছুদিন ধরে অসুস্থতার লক্ষণ ছিল, হয়তো হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।” আবার গ্রামের একজন রহস্যময় কণ্ঠে বলল, “এটা কোনো অভিশাপও হতে পারে। কৃষ্ণর জমিতে কিছুদিন আগে একটা প্রাচীন মূর্তি খুঁজে পেয়েছিল। ও সেটা নিয়ে মজা করেছিল, হয়তো সেই কারণে এমন হলো।”
ময়নাতদন্তের অপেক্ষা
পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে বিষ্ণুপুর জেলা হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায়। কিন্তু তার আগে থেকেই রহস্য ঘনীভূত হচ্ছিল।
জমিতে কাজ করা বাকিরা জানাল, তারা সাপের কোনো চিহ্ন দেখেনি। চিকিৎসকেরা বললেন, সাপে কামড়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বিষ্ণুপুর হাসপাতালের রিপোর্ট আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তবে তার শরীরে কোনো দৃশ্যমান ক্ষত ছিল না, যা সাপের কামড়ের দিকে ইঙ্গিত করে।
রহস্যের সূত্র খোঁজা
গ্রামের এক বৃদ্ধ, যে অতি প্রাচীন লোকগল্পে বিশ্বাসী, বলল, “এই মাটিতে রহস্য লুকিয়ে আছে। অনেক বছর আগে এই জমিতে যুদ্ধ হয়েছিল। মৃত আত্মারা এখানে ঘুরে বেড়ায়। কৃষ্ণ হয়তো তাদের রোষের শিকার হয়েছে।” অন্যদিকে, কৃষ্ণের এক বন্ধু বলল, “জমিতে পোকামাকড়ের জন্য যে রাসায়নিক স্প্রে করা হয়েছিল, তা থেকে বিষক্রিয়া হতে পারে।”
শেষ প্রশ্ন
কৃষ্ণ সোরেনের মৃত্যু আসলে কীভাবে হলো? সাপের কামড়, হার্ট অ্যাটাক, নাকি কোনো অজানা বিষক্রিয়া? পরিবার এবং গ্রামের মানুষ ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অপেক্ষায় রয়েছে।
জীবনের শেষ মুহূর্তে কৃষ্ণ হয়তো তার প্রাণের আলু গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রকৃতি, রহস্য, এবং মৃত্যুর মধ্যকার এই গল্পে সেই শব্দগুলো অমীমাংসিতই থেকে গেল।
|| সমাপ্ত ||
________