সকাল থেকেই চারদিক আচ্ছন্ন কুয়াশায়। গ্রামের রাস্তা, মাঠের জমি, এমনকি গাছের পাতাগুলোর ওপরও যেন সাদা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে প্রকৃতি। হুগলীর এক ছোট্ট গ্রাম মাধবপুর। এখানকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। আর এই সময়ে আলু চাষ তাদের জীবিকার প্রধান উৎস।
নিরুপমা, এক মধ্যবয়সী কৃষক, সকালে উঠে জমির দিকে পা বাড়ান। মাথায় কাপড় জড়ানো, হাতে মাটি লেগে থাকা চটির রেকাব। তাঁর জমিতে আলুর গাছগুলো কেমন যেন মলিন দেখাচ্ছে। পাতা থেকে জল পড়ছে টুপটুপ করে।
“এত কুয়াশায় গাছগুলোকে আর বাঁচানো যাবে তো?” পাশে দাঁড়ানো সহচাষী শম্ভু কাকাকে প্রশ্ন করলেন নিরুপমা।
“আমার তো মনে হয় না, মেয়ে। গাছের পাতায় শোষক পোকার দল আক্রমণ চালাচ্ছে। কুয়াশা যদি এমনই থাকে, আলুর ফলন এবার বড্ড খারাপ হবে,” দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শম্ভু কাকা।
আলুর জমি ছিল এই গ্রামের আয়ের প্রধান ভরসা। কিন্তু গত কয়েকদিনের টানা কুয়াশা এবং আর্দ্র আবহাওয়া তাঁদের সমস্ত আশা নষ্ট করে দিয়েছে। শোষক পোকার আক্রমণে জমিতে থাকা আলুগুলো গাছেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
কৃষকদের লড়াই
নিরুপমা আর তাঁর স্বামী বিমল রাতদিন পরিশ্রম করেও আলু চাষ থেকে তেমন লাভ পান না। খরচ দিন দিন বাড়ছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে কীটনাশক প্রয়োগ করা ছাড়া আর উপায় নেই। প্রতিটি বিঘা জমিতে এখন বাড়তি খরচ বেড়ে গেছে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা।
“বউ, যদি এমন হয় যে চাষের খরচই উঠে আসে না, তাহলে বাজারে আমাদের আলুর দামও কি বেড়ে যাবে?” বিমল সন্ধ্যায় খাবার খেতে খেতে নিরুপমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
“কী জানি গো। আলুর দাম বাজারে যা শুনি, তাতে তো মনে হয়, আমরা চাষীরা কিছুই পাই না। পাইকাররা মাঝখানে সব লুটে নেয়। এবার এই খরচ বাড়লে, আমরা টিকে থাকতে পারব তো?” নিরুপমার চোখের কোনে জল।
বাজারের হিসাব
শহরের বাজারে আলুর দাম এখন ২৫ টাকা প্রতি কেজি। কিন্তু চাষীরা সেই আলু বিক্রি করতে পারেন মাত্র ১০-১২ টাকায়। তাতেও যে সব খরচ ওঠে, তা নয়। আলু চাষে সার, বীজ, শ্রমিকের মজুরি, জল দেওয়ার খরচ—সব মিলিয়ে এক বিশাল পরিমাণ ব্যয়। কুয়াশা ও কীটনাশকের বাড়তি খরচ সেই বোঝা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
বাজারে আলুর দাম কমার যে আশা ছিল, তা এই পরিস্থিতিতে এখন অসম্ভব। কারণ আলুর ফলন কমলে যোগান কমে যাবে, চাহিদা বাড়বে, এবং দামে তার প্রভাব পড়বেই।
প্রকৃতির কাছে অসহায়
চাষীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে যেন অসহায়। শম্ভু কাকা বললেন, “আমাদের কী করার আছে বলো? আকাশটা যদি পরিষ্কার না হয়, আমরা বাঁচব কী করে?”
একদিন গ্রামের সকল চাষী মিলে আলুর জমির পাশে বসে কথা বলছিলেন। কুয়াশা মাটির ওপর ধোঁয়ার মতো জমে ছিল। বিমল বললেন, “আমরা সবাই যদি একত্রে কীটনাশক কিনি, খরচ কিছুটা কমতে পারে। কিন্তু বাজারে যদি ভালো দাম না পাই, তাহলে কি কোনো লাভ হবে?”
নিরুপমা বললেন, “আমাদের কথা কেউ শোনে না। আলুর দাম ঠিক করে বড় ব্যবসায়ীরা। আমরা যা করি, তা নিজেদেরই গলা কাটার মতো।”
অবশেষে
কুয়াশার দাপট কিছুটা কমলে নিরুপমা জমির দিকে তাকিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। আলুর গাছগুলো এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ফলন হয়তো খুব ভালো হবে না, তবুও গাছগুলো যেন মাটি আঁকড়ে ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
চাষীদেরও বাঁচতে হবে। যে সংগ্রাম তাঁদের প্রতিদিন করতে হয়, তা অন্য কারও বোঝা কঠিন। আলু চাষের প্রতিটি গাছ যেন তাঁদের জীবনের প্রতীক। যত বাধা আসুক, লড়াই থামবে না।
উপসংহার
এই গল্প কেবল এক গ্রামের নয়। এটা প্রতিটি চাষীর জীবনযুদ্ধের গল্প। প্রকৃতি যখন দয়া দেখায় না, তখন চাষীদের লড়াই আরও কঠিন হয়ে যায়। তবু তারা ভরসা হারায় না, কারণ তারা জানে, প্রতিটি কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল শেষে একদিন রোদ উঠবেই।
বিঃ দ্রঃ – শীতের কুয়াশা আর আলু-চাষিদের শঙ্কা নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট এর ভিত্তিতে লেখা।
|| সমাপ্ত ||
_______