গ্রামের নাম ছিল খুশিপুর। ছোট্ট, সবুজে ঘেরা, অথচ দারিদ্র্যের ছাপ গ্রামজুড়ে স্পষ্ট। এখানকার মানুষ মূলত চাষাবাদ করে জীবন চালায়, কিন্তু প্রকৃতির অবহেলা আর দীর্ঘ দিনের অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে তাদের জীবন প্রায়ই থমকে দাঁড়ায়।
শরৎ মাসের এক দুপুরে গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটছিলেন একজন সমাজসেবক, নাম ব্রিজেশ। শহরে প্রতিষ্ঠিত একজন ইঞ্জিনিয়ার হলেও, গ্রামের জন্য কিছু করার ইচ্ছা তাকে বারবার টেনে আনত এই মানুষগুলোর কাছে। গ্রামের মানুষদের সমস্যাগুলো তিনি শুনতে চেয়েছিলেন, আর এই উদ্দেশ্যেই এসেছিলেন খুশিপুর।
পথে তার দেখা হলো গফুর চাচার সাথে, গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ একজন চাষি। মাথায় সাদা গামছা বাঁধা, রোদে পোড়া মুখ। তাকে দেখে ব্রিজেশ বলল, “চাচা, কেমন আছেন?”
গফুর চাচা একটু মুচকি হাসলেন, বললেন, “ভালো তো বেটা। তুমিই বল, শহুরে মানুষ এসে গ্রাম দেখতে আসে, সেও তো এক আশ্চর্যের কথা।”
“আমার মন তো এখানে পড়ে থাকে চাচা। আপনাদের এই মাঠ, খেত, ফসলের ঘ্রাণ ছাড়া জীবন বড়ই রুক্ষ মনে হয়।”
গফুর চাচা মোহিতের মনের আন্তরিকতা বুঝতে পেরে বললেন, “আসলেই, শহরের মানুষ এসে যদি আমাদের একটু দেখে রাখতো, হয়তো গ্রামের মানুষদের জীবনেও কিছু পরিবর্তন আসতো।”
এ কথায় ব্রিজেশ গভীরভাবে চিন্তিত হলেন। তিনি খেয়াল করলেন, গ্রামের জমি উর্বর হলেও চাষের জন্য নেই সঠিক সেচব্যবস্থা। বছরে একবার ভাল ফসল পেলেও তাতে সংসারের চাহিদা মেটানো যায় না। গ্রামের পাশ দিয়ে যে নদীটা বয়ে গেছে, সেখান থেকে জল তুলে সেচের ব্যবস্থা করতে পারলে ফসলের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যেত।
ব্রিজেশ ভাবলেন, “যদি এখানে একটা পাম্পিং সেচ প্রকল্প করা যায়, তাহলে হয়তো গ্রামের পরিস্থিতি পাল্টে যাবে।”
পরদিনই তিনি শহরে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করলেন, কীভাবে গ্রামের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করা যায়। ধীরে ধীরে তার বন্ধুদের সাথে এই প্রকল্পে অনেকেই যোগ দিল। কিছু দিনের মধ্যেই গ্রামে এসে তারা পাম্প বসিয়ে একটা সেচব্যবস্থা চালু করতে শুরু করল।
গ্রামের মানুষজন এই পরিবর্তন দেখে অভিভূত। সেই গফুর চাচা আর গ্রামের অন্যান্য চাষিরা একসাথে মাঠে দাঁড়িয়ে দেখল পাম্প দিয়ে জল উঠছে, শুকনো জমিতে প্রাণের সঞ্চার হচ্ছে। এবার তারা ধান ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি চাষ করার সাহস পেলো। গফুর চাচা বললেন, “বেটা ব্রিজেশ, তোর জন্যই এই গ্রামটা এখন নতুন রূপ পাচ্ছে।”
ব্রিজেশ মৃদু হেসে বলল, “চাচা, এতো আপনাদের পরিশ্রমের ফল। আমি তো শুধু সাহায্য করতে চেয়েছি।”
মাস ঘুরতেই গ্রামের মাঠে সবুজের সমারোহ। ফসলের ফলনও দ্বিগুণ হয়েছে। গ্রামের চাষিরা নিজেদের ফসল বাজারে নিয়ে গিয়ে ভালো দাম পাচ্ছে। সবার মুখে তখন একটাই কথা, “আমাদের জীবনটা বদলে গেছে। আমাদের পরিশ্রমের দাম এখন আমরা বুঝতে পারছি।”
এইভাবে মোহিতের উদ্যোগ আর গ্রামের চাষিদের পরিশ্রমে খুশিপুর গ্রামের জীবনযাত্রা পাল্টে গেল। সফল হয়েছে খুশিপুর নামটিও। তাদের নতুন আশার আলো দেখানো সেই সমাজসেবী এখনো মাঝে মাঝে গ্রামে আসেন। নিজের হাতে লাগানো এই ছোট্ট স্বপ্নের ক্ষেত্রকে দেখে মন ভরে যায়।
|| সমাপ্ত ||