রোদের আলো যেন ম্রিয়মাণ, মাটির গন্ধে শীতের ঠান্ডা শীতলতা যেন আরও তীব্র। এমনই এক জানুয়ারির সকালের কথা, পূর্বস্থলীর ধীতপুরের কৃষক রবীন্দ্রর জীবনের আরেকটি আশাহীন দিন। বিশাল বিস্তৃত সবুজ জমিতে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি ফুলকপি—যেন কৃষকের মনের বোবা প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি।
রবীন্দ্র নিজের গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “এতদিনের কষ্ট, এত পরিশ্রম… আর ফলাফল? এক টাকা! তাও কিনতে চায় না কেউ।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোটো ভাই বিনোদের মুখেও একই হতাশা।
“ভাই, এত সবজি ফেলে দিচ্ছি, অথচ বাড়ির খরচ চলছে ধার করে,” বিনোদ বলল।
কয়েক মাস আগে পরিস্থিতি অন্যরকম ছিল। ফুলকপির দাম তখন আকাশছোঁয়া। প্রতিবেশী কৃষকদের সঙ্গে বসে জমিতে চায়ের কাপ হাতে রবীন্দ্র স্বপ্ন দেখেছিলেন। নতুন সেচযন্ত্র কেনা হবে। ছোটো মেয়েটার পড়াশোনার খরচ মিটবে। কিন্তু হঠাৎ যেন সব উলটপালট হয়ে গেল। বাজার ভরে গেল ফুলকপিতে। ক্রেতাদের চাহিদা পড়ে গেল। এক টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না।
“এই কপিগুলো তোলা না হলে পরের ফসল লাগাতে পারব না,” রবীন্দ্র চিন্তিত মুখে বলল।
বিনোদ কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ল। “তবে করব কী ভাই?”
কথার উত্তর দেওয়ার সাহস নেই রবীন্দ্রর। কয়েকদিন আগে হাটে নিয়ে গিয়ে কপি বিক্রির চেষ্টা করেছিল। গরম রোদে বসে থেকেও দাম মেলেনি। এক টাকার কমেও যারা নিতে চায়নি। শেষে হতাশ হয়ে অনেকগুলো ফেলে দিয়ে ফিরতে হয়েছিল।
দুপুরের দিকে গ্রামে ফিরে রবীন্দ্র দেখল, তার মেয়ে তুলসী স্কুল থেকে ফিরেছে। বইখাতা নিয়ে বারান্দায় বসে আছে। তাকে দেখে মেয়েটি চুপ করে তার দিকে তাকাল। সেই চোখে ছিল ছোটো একটি প্রশ্ন, “বাবা, আমাদের দিন কবে ফিরবে?”
রবীন্দ্র মনের ভেতরে একটা ভারি পাথর অনুভব করল। হয়তো সে উত্তর জানে না। কিন্তু সে জানে, জীবনটা যেমনই কঠিন হোক, তাকে লড়াই করতে হবে। যদি এক টাকার ফুলকপি নিয়েও লড়াই চালিয়ে যেতে হয়, তবে তাই হোক।
বিকেলের সূর্যের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছিল, কিন্তু রবীন্দ্রর চোখে ছিল এক অন্য আলো। ফুলকপি হয়তো সাময়িকভাবে তাকে পরাজিত করেছে, কিন্তু কৃষক রবীন্দ্রর লড়াইয়ের গল্প এখানেই শেষ নয়।
বিঃ দ্রঃ – বাংলার ফুলকপি চাষিদের করুন কাহিনী নিয়ে লেখা।
|| সমাপ্ত ||
________