মালদহের ইংলিশবাজার শহরের এক শান্ত সকালে, সিদ্ধান্ত পরিবারের উঠোন ভরে উঠেছে অতিথি, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুদের পদচারণায়। উঠোনের একপাশে বিশাল এক প্যান্ডেল টাঙানো হয়েছে, তার নিচে চলছে পুজোর আয়োজন। কিন্তু আজকের দিনটা ছিল একটু অন্যরকম—আজ উপনয়ন হচ্ছে পরিবারের ছোট মেয়ে, ন’বছরের মধুপর্ণা সিদ্ধান্তের!
প্রথাগত নিয়ম অনুযায়ী, উপনয়ন মানেই ছেলেদের জন্য। কিন্তু বাবা মনোজকুমার সিদ্ধান্ত আর মা পায়েল সিদ্ধান্ত মনে করলেন, “ছেলেদের হলে মেয়েদের কেন নয়?” সমাজের বাঁধাধরা গণ্ডি ভাঙতে তাঁরা এগিয়ে এলেন ছোট মেয়েকে নিয়েই।
ছোট্ট মধুপর্ণা, বড় এক উদ্যোগ
মধুপর্ণা তখনও বুঝতে পারছিল না এই পুরো আয়োজনের গুরুত্ব। তার চোখে ছিল শুধু কৌতূহল আর আনন্দ। দাদা-দিদিদের মতো সেও পৈতে পরবে, মন্ত্র উচ্চারণ করবে—এতেই তার খুশি। বন্ধুরা তাকে ঘিরে ধরেছে, কেউ বলছে, “তুই পৈতে পরবি? মেয়েরা তো পৈতে পরে না!” মধুপর্ণা হেসে উত্তর দিল, “আমি তো পড়ব! বাবাই বলেছে, আমি পারব।”
মনোজবাবু কন্যার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললেন, “সমাজের নিয়ম গড়ে দেয় মানুষ। আমরা চাই, সেই সমাজে মেয়েরা সমান সুযোগ পাক।”
যজ্ঞ, মন্ত্র আর ইতিহাসের পুনর্জন্ম
যজ্ঞমঞ্চে বসেছেন পুরোহিত সদানন্দ বাগচি। চারদিকে ধূপের গন্ধ, সংস্কৃত মন্ত্রের ধ্বনি আর প্রদীপের আলোয় এক পবিত্র আবহ তৈরি হয়েছে। মধুপর্ণার কপালে চন্দনের টিপ, গলায় তুলসীর মালা। পুরোহিত তাকে শিখিয়ে দিচ্ছেন মন্ত্র, সে মন দিয়ে শুনছে, উচ্চারণ করছে যত্ন নিয়ে।
এতদিন ধরে যা শুধুমাত্র ছেলেদের জন্য ছিল, আজ সেখানে মেয়েও স্থান পেল। পরিবার, আত্মীয়-পরিজনেরা একসঙ্গে হাততালি দিয়ে উঠলেন। পায়েলদেবীর চোখে জল—গর্বের জল। তিনি স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যা করলে, তা ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে।”
সমাজের নতুন বার্তা
অনুষ্ঠান শেষে যখন সবাই এক কাপ চায়ে চুমুক দিচ্ছে, তখন মধুপর্ণা তার বাবার কাছে এসে বলল, “বাবা, পৈতে পরলেই কি সব শেখা হয়ে যায়?”
মনোজবাবু হেসে বললেন, “না রে! শেখার কোনো শেষ নেই। তবে আজ থেকে তোর যাত্রা শুরু হল।”
পাশ থেকে এক আত্মীয় ফিসফিস করে বললেন, “সমাজ কি মানবে?”
মনোজবাবু দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “সমাজ তো বদলাচ্ছে! আমাদের একটা পদক্ষেপ হয়তো অনেক মেয়ের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে।”
সেদিনের পর থেকে মধুপর্ণা শুধু একটা ছোট মেয়ে নয়, সে হয়ে উঠল এক পরিবর্তনের প্রতীক, এক নতুন যুগের বার্তাবাহক।
বিঃ দ্রঃ – মালদার ঘটনা অবলম্বনে লিখিত।
|| সমাপ্ত ||