HomeStory of WestbengalSantipur, Nadia: হাসান শেখের ভগবান

Santipur, Nadia: হাসান শেখের ভগবান

এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে গেলেন

হাসানকে দেখে প্রথমেই যে কেউ বুঝে যেত, তার চোখে কিছু সমস্যা রয়েছে। গোপালপুরের ছোট্ট গ্রামে, দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেওয়া এই দশ বছরের ছেলেটি ক্লাসের পড়া বোর্ডে তো দূরের কথা, বইয়ের পাতায় লেখা দেখতেও হিমশিম খেত। তার বাবা কামাল শেখ, পেশায় রাজমিস্ত্রি, আর মা আমিনা বিবি সংসার সামলাতেন। তাঁরা ছেলের এই ‘জন্মগত’ সমস্যাকে অদৃষ্টের বিধান বলে মেনে নিয়েছিলেন।

তবে হাসানের স্কুলের প্রধান শিক্ষক সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তা মেনে নিতে পারলেন না। শান্তিপুরের কাজী নজরুল বিদ্যাপীঠের এই শিক্ষক বিশ্বাস করতেন, প্রতিটি শিশুর প্রতিভা বিকশিত হতে পারে যদি তাদের সঠিক সুযোগ দেওয়া হয়। আর তাই হাসানের ক্ষীণদৃষ্টি তাঁকে ভাবিয়ে তুলল।

প্রথম থেকেই সোমনাথবাবু লক্ষ্য করছিলেন, হাসান ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়ে চোখ কুঁচকায়, বইয়ের অক্ষর চোখের একদম কাছে এনে দেখে। তাঁর মনে হলো, ডাক্তার দেখানো ছাড়া এর সমাধান সম্ভব নয়।

একদিন স্কুল ছুটির পর সোমনাথবাবু হাসানের বাবা-মাকে ডেকে পাঠালেন। কামাল আর আমিনা প্রথমে একটু ভড়কে গেলেন। “হাসান ঠিক মতো পড়ছে তো?” জিজ্ঞেস করলেন আমিনা।

“ছেলে খুব মেধাবী, কিন্তু ওর চোখের সমস্যাটা বাড়ছে,” শান্ত গলায় বললেন সোমনাথবাবু। “আমার মনে হয়, ভালো কোনো ডাক্তার দেখানো দরকার। হয়তো ঠিকমতো চিকিৎসায় এটা সেরে যাবে।”

সোমনাথবাবুর কথায় বিশ্বাস রেখে তাঁরা হাসানকে নিয়ে কলকাতার এনআরএস মেডিক্যাল কলেজে গেলেন। ডাক্তাররা পরীক্ষা করে জানালেন, হাসানের চোখে জন্মগত ছানি রয়েছে। অপারেশন করলেই দৃষ্টি ফিরে আসবে।

তবে খবরটা শুনে কামাল আর আমিনার মুখ শুকিয়ে গেল। “অপারেশন? এত বড় ঝুঁকি আমরা নিতে পারব না,” বললেন কামাল। অপারেশনের ভয় আর আর্থিক অনটন তাঁদের পিছু হটিয়ে দিল।

হাসানের বাবা-মা ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলেও, সোমনাথবাবু হাল ছাড়লেন না। “একটা ছোট্ট অপারেশনের জন্য হাসান আজীবন অন্ধকারে থাকবে, এটা আমি মানতে পারি না,” বললেন তিনি।

স্কুলে কিছুদিন পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবিরের আয়োজন করা হলো। সেখানে একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সোমনাথবাবু তাঁকে দিয়ে আবার হাসানকে পরীক্ষা করালেন। বিশেষজ্ঞও জানালেন, অপারেশনই একমাত্র উপায়।

এবার সোমনাথবাবু নিজেই হাসানের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের বোঝালেন। “এটা কঠিন কিছু না। আপনারা চাইলে আমি পুরো প্রক্রিয়ায় পাশে থাকব।” অনেক বোঝানোর পর অবশেষে তাঁরা রাজি হলেন।

অপারেশনের দিন হাসানকে শান্তিপুর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। চিকিৎসক প্রদীপ মজুমদার জানালেন, এত কম বয়সে এমন অপারেশন সহজ নয়। তবে তাঁর বিশ্বাস ছিল, হাসান সুস্থ হয়ে উঠবে।

অপারেশন শুরু হলো। কামাল আর আমিনা হাসপাতালের বাইরে বসে থাকলেন, মুখে চিন্তার ছাপ। সোমনাথবাবুও পাশে বসে তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।

দু’ঘণ্টার অপারেশন শেষে চিকিৎসক বাইরে এসে হাসি মুখে জানালেন, “অপারেশন সফল হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই হাসান দেখতে পাবে। মাস ছয়েক পর অন্য চোখেও অপারেশন করা হবে।”

খবরটা শুনে আমিনা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। “আমার ছেলে দেখতে পাবে!” চিৎকার করে উঠলেন তিনি। কামালের মুখেও দীর্ঘদিন পর হাসি ফুটল।

কয়েক দিনের মধ্যেই হাসানের চোখ থেকে ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হলো। প্রথমবার সে স্পষ্টভাবে আলো দেখতে পেল। “আম্মা, আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি!” হাসান আনন্দে চিৎকার করল।

আমিনা ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। “তোমার জন্যই আজ এই মিরাকল হলো,” কামাল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সোমনাথবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন।

সোমনাথবাবু শুধু মুচকি হেসে বললেন, “হাসানকে স্কুলে ঠিকঠাক পড়তে দেখার থেকে বড় কোনো পুরস্কার আমার জন্য নেই।”

হাসান দ্রুতই পড়াশোনায় ফিরে গেল। ক্লাসে সে এখন ব্ল্যাকবোর্ডের সব লেখা স্পষ্ট দেখতে পায়। পড়ায় তার আগ্রহ দ্বিগুণ বেড়ে গেল।

গোপালপুর গ্রামে হাসানের গল্প সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামের অন্য অভিভাবকেরাও তাঁদের ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতন হতে শুরু করলেন।

অন্ধকার থেকে আলোয় আসার এই যাত্রায় হাসান যেমন নতুন দৃষ্টি পেল, তেমনই সোমনাথবাবু আরও একবার প্রমাণ করলেন, একজন শিক্ষকের ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধের কাছে কোনো বাধাই অতিক্রম্য নয়।

|| সমাপ্ত ||

________

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন