নতুনবাজার এলাকার ছোট্ট বাড়িটির সামনের গেটটা আজ আবার খুলে গেছে। বাড়ির লোকেরা জানে, নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে এলেই এ বাড়ির পরিবেশটা যেন খানিকটা আলাদা হয়ে যায়। বাড়ির মেজো পুত্রবধূ কাকলি সকালে উঠেই শাশুড়ি মন্দাকিনী পণ্ডাকে নিয়ে ব্যস্ত। ১০৫ বছর বয়সে মানুষটা যেন এখনও একইরকম জীবন্ত, হাসিখুশি। বার্ধক্যজনিত সমস্যা থাকলেও, মনের শক্তি এতটুকুও কমেনি। তিনি নিজের কাজ নিজেই করেন, এমনকি ভোটের দিনটাতে তাঁর উত্তেজনা বাড়ির সবার মাঝে আরও বেশি করে ছড়িয়ে পড়ে।
সকালের রোদে বসে মন্দাকিনী তাঁর প্রিয় পানের খিলি চিবোচ্ছেন। প্রায় ৪০ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছেন, কিন্তু মনের অদম্য শক্তি তাঁকে জীবনের প্রতি আরও আগ্রহী করে রেখেছে। পাশে বসে কাকলি মাঝে মাঝে তাঁর চুলে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। “মা, এইবারও তো ভোটকর্মীরা বাড়িতেই আসবে, তাই তো?” কাকলির প্রশ্নে হালকা হাসেন মন্দাকিনী, “আমার ভোটের জন্য ওরা আসবে না তো কিসের জন্য!”
ভোটের দিন আসতে না আসতেই পুরো এলাকাজুড়ে যেন একটা উৎসবের আবহ তৈরি হয়। বাড়ির কাছেই রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল, যেখানে একসময় ভোট দিতে যেতেন তিনি। রিকশায় চেপে তাঁর সেই পুরনো স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এখন তাঁর স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। তবে আজকাল আর সেই পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয় না। ভোটকর্মীরাই তাঁকে সম্মান জানিয়ে বাড়িতে আসেন, যাতে তিনি নিজের অধিকার পালন করতে পারেন।
সেদিন সকালে বাড়ির সামনে কিছু লোকজনের জটলা দেখা গেল। ভোটকর্মীরা এসে গেছেন মন্দাকিনী পণ্ডার ভোট নেওয়ার জন্য। তাঁর কৌতূহলী চোখে এক ঝলক আলো ঝলমল করে ওঠে। “তোমরা সবারে সরে যাও, আমি নিজে আমার ভোট দেব,” মন্দাকিনীর কণ্ঠে দৃঢ়তা যেন আশ্চর্য করে দেয় সবাইকে। বাড়ির লোকেরা একটু দূরে সরে দাঁড়ায়, যেন তিনি স্বাধীনভাবে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার পালন করতে পারেন।
মন্দাকিনীর মেয়ে এবং নাতিরা সবসময় তাঁর এই স্বাধীন মনোভাব দেখে আনন্দ পান। প্রিন্স, মন্দাকিনীর নাতি, ব্যারাকপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। ছুটিতে বাড়ি এলে সে ঠাকুমার যত্ন নেয়, তাঁর চুল কেটে দেয়। চুল বড় হয়ে গেলে ঠাকুমা নিজেই বলে ওঠেন, “প্রিন্স, চুলগুলো একটু কেটে দে।” পায়ের নখ কাটার কথা বললেই হাসি ফোটে মন্দাকিনীর মুখে। “ছোট করলে কিন্তু আমি রেগে যাব”, বলে ওঠেন তিনি।
ভোটকর্মীরা যখন তাঁর ভোটের প্রক্রিয়া শেষ করে, তখন বাড়ির সকলেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ায়। কাকলি মৃদু হেসে বলেন, “শাশুড়ি মা নিজের ভোট নিজে দেন, ওঁর মতো কেউ সামনে আসুক সেটা তিনি চান না। এটা তাঁর অধিকার, এবং তাঁকে সেটা পালন করতে দিতেই হয়।” প্রায় শতাধিক বছর বয়সী এই নারী এখনও গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে এতটা সচেতন, যা দেখে এলাকার সবাই বিস্মিত হয়ে যায়।
বাড়ির পাশের সড়ক দিয়ে আসা যাওয়া করা মানুষরা প্রায়শই তাকিয়ে থাকে এই বৃদ্ধাকে দেখে। এলাকায় তাঁর পরিচয় শুধু একজন বৃদ্ধা হিসেবে নয়, বরং একজন স্বাধীন, দৃঢ়চেতা নাগরিক হিসেবে। প্রায় প্রতি বছর কাউন্সিলর সহদেব চৌধুরী নিজে তাঁর জন্য লাইফ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে দেন। মন্দাকিনী তাঁকে দেখলেই হালকা হাসেন, যেন কৃতজ্ঞতায় তাঁর চোখে জল আসে।
ভোটের পরে বাড়িতে ফিরে এসে মন্দাকিনী তাঁর অতীতের কথা মনে করেন। “আমার বাবার বাড়ি ডেবরার রসুলপুর গ্রামে। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনা তেমন করতে পারিনি,” স্মৃতির মধ্যে ভেসে যান তিনি। নিজের নাম সই করতে পারলেও, এখন হাতের লেখাটা আর আগের মতো নেই। তবুও তিনি নিজের নাম সই করেই ভোট দেন, যেন জীবনের এই কাজগুলো তাঁর কাছে আনন্দের।
একদিন ব্যাংকে টাকা তুলতে গিয়েছিলেন তিনি। ব্যাংকের কর্মীরা যখন তাঁর বয়স দেখে অবাক হয়ে যান, তখন তাঁর মুখে একটা প্রশান্ত হাসি ফুটে ওঠে। কেউ কেউ তাঁকে প্রণাম করে, সম্মান জানায় তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতাকে। তাঁর মনের শক্তি, এই দীর্ঘ জীবন এবং তাঁর গণতান্ত্রিক সচেতনতা সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করে।
মন্দাকিনীর প্রায় শতাধিক বছর বয়স হলেও, জীবনের প্রতি তাঁর আগ্রহ কমেনি। তাঁর মনে এখনও সেই জীবনীশক্তি রয়েছে, যা তাঁকে মানুষের চোখে প্রেরণার প্রতীক করে তুলেছে। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন এই বৃদ্ধা প্রমাণ করেন যে বয়স কেবলমাত্র একটি সংখ্যা।
ভোটের দিন শেষ হলে, এলাকাবাসী মন্দাকিনীর জীবনের গল্প আলোচনা করে। সবাই মিলে বলেন, “উনি আমাদের সবার জন্য এক জীবন্ত উদাহরণ।” তাঁর ছোট পুত্রবধূ কাকলি, ছেলে এবং নাতিরাও গর্বিত। মন্দাকিনীর মতো একজন মানুষকে কাছে পাওয়া তাঁদের কাছে আশীর্বাদের মতো।
একদিন সন্ধ্যাবেলা মন্দাকিনী নিজের ছোট ঘরে বসে বসে জানালা দিয়ে বাইরের আলো দেখে ভাবতে থাকেন, “জীবনটা সত্যিই সুন্দর। এত কষ্টের মধ্যেও বেঁচে থাকা একটা আনন্দ।” তাঁর চোখে ঝিলিক দেয় এক অসীম শান্তি আর সন্তুষ্টির অনুভূতি।
শেষ পর্যন্ত মন্দাকিনী নিজের দীর্ঘ জীবনের সার্থকতার এক আনন্দে মেতে থাকেন। তাঁর একটাই ইচ্ছে, যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন নিজের অধিকার পালন করবেন। তাঁর এই অবিচল মনোভাব আসলে এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকে সকলের জন্য, যা দেখে এলাকাবাসী, পরিবার এবং নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হয়।
এভাবেই জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝে, শত বছরের মন্দাকিনী পণ্ডা যেন প্রতিদিন নতুন করে নিজেকে আবিষ্কার করেন, এবং ভবিষ্যতের প্রতি এক নতুন প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচেন।
|| সমাপ্ত ||
________