ভারতের পূর্বপ্রান্তে মালদহের হবিবপুরের শান্ত গ্রাম্য পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব সাক্ষী, সিঙ্গাবাদ রেলস্টেশন। প্রথম নজরে এটি হয়তো আর দশটা ছোট স্টেশনের মতোই মনে হবে। কিন্তু এর বুকে লুকিয়ে আছে এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। ভারতের শেষ রেলস্টেশন হিসেবে পরিচিত এই জায়গাটি শুধু ভৌগলিক নয়। ঐতিহাসিক গুরুত্বেও অনন্য।
ব্রিটিশদের নির্মাণ
১৮৮৮ সাল। ব্রিটিশরা তখন ভারতের রেলপথ সম্প্রসারণে ব্যস্ত। মূল উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত পণ্য পরিবহন এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম সহজ করা। সিঙ্গাবাদ রেলস্টেশন তৈরি হয়েছিল তৎকালীন কলকাতা ও ঢাকার মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার জন্য। এই পথ দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন যেত, যাত্রীরা যেতেন তাদের গন্তব্যে। স্টেশনটি শুধুমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম নয়, একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
নেতাজি ও মহাত্মা গান্ধীর স্মৃতি
সিঙ্গাবাদের গৌরবময় অধ্যায়ের আরেকটি দিক হলো এই পথে বিখ্যাত ব্যক্তিদের যাত্রা। কথিত আছে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু ও মহাত্মা গান্ধী দু’জনেই এই রেলপথ ব্যবহার করেছিলেন। ১৯২০-এর দশকে গান্ধীজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলনের সময় এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন। নেতাজি এই পথ দিয়েই তাঁর দেশব্যাপী কর্মকাণ্ড পরিচালনার সময় পাড়ি দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা ও বিচ্ছেদ
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সঙ্গে দেশভাগের বেদনাদায়ক অধ্যায় শুরু হয়। সিঙ্গাবাদ রেলস্টেশন একসময় সংযোগ স্থাপন করত দুই বাংলার মধ্যে। কিন্তু দেশভাগের পর সেই সংযোগ ভেঙে যায়। রেলপথ রয়ে গেল, কিন্তু তার কার্যকারিতা সীমিত হয়ে গেল।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর, স্টেশনটি বন্ধ হয়ে যায়। যাত্রীবাহী ট্রেনের বদলে কেবলমাত্র মালগাড়ি চলাচল করতে শুরু করে। স্টেশনটি রয়ে গেল এক স্মৃতিচিহ্ন হয়ে, যেন অতীতের এক প্রহরী।
আধুনিক যুগে সিঙ্গাবাদ
আজ সিঙ্গাবাদ স্টেশন আর সেই ব্যস্ততা নেই। এটি মূলত পণ্য পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা ভারতের মালদহ থেকে বাংলাদেশের রহনপুর পর্যন্ত মালগাড়ি যাতায়াতের কাজে ব্যবহৃত হয়। স্টেশনের নামের নিচে লেখা “ভারতের শেষ রেল স্টেশন”—এটি একদিকে গর্বের, অন্যদিকে নস্টালজিয়ার। স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাছে এটি শুধু একটি স্টেশন নয়, তাদের অতীতের এক সেতু যা দুই দেশকে একত্র করেছিল।
ইতিহাসের শেষ প্রহরী
সিঙ্গাবাদ স্টেশনটি এখন প্রায় পরিত্যক্ত। তবে এর নীরব উপস্থিতি মনে করিয়ে দেয় ইতিহাসের নানা অধ্যায়। ব্রিটিশ আমলের রেল নেটওয়ার্ক, স্বাধীনতার সংগ্রাম, দেশভাগের বেদনা এবং বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস—সবই এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে।
স্টেশনের পুরনো প্ল্যাটফর্ম, ধূসর রং ধরা বিল্ডিং, এবং সেই সময়ের সিগনাল পোস্টগুলো যেন আজও ইতিহাসের গল্প বলে।
শেষ কথা
সিঙ্গাবাদ কেবলমাত্র একটি রেলস্টেশন নয়, এটি এক অতীতের দৃষ্টান্ত। সময়ের পরিবর্তনে হয়তো এর কার্যকারিতা কমে গেছে। কিন্তু এর ইতিহাসের ওজন কোনোদিনও কমবে না। প্রতিটি ট্রেনের হুইসেলের সঙ্গে সিঙ্গাবাদ যেন কানে কানে বলে যায়, “আমি ছিলাম, আছি, এবং থাকব। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।”
|| সপ্তাহ ||
________