নীলনির্জন জলাধার। একসময় এর চারপাশে শুধু সবুজের ছোঁয়া, আর জলাশয়ের শীতল বাতাসে প্রকৃতি মগ্ন ছিল। এখন, জলাশয়ের বুক জুড়ে ভাসমান সৌর প্যানেল বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চিরাচরিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ধোঁয়ার পরিবর্তে, এখানে সৃষ্ট হবে পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ। তবে, এই প্রকল্প সফল হবে কিনা তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন। আর সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সমীক্ষা চলছে।
প্রকল্পের শুরু
প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার, বড় স্বপ্ন দেখছেন। “ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক নতুন অধ্যায় নয়, এটি আমাদের গ্রিন এনার্জি ভবিষ্যৎকে নতুন পথ দেখাবে,” বললেন তিনি।
কিন্তু সহজ ছিল না এই পথ। জলাশয়ের গভীরতা, ঢেউয়ের শক্তি, তাপমাত্রার ওঠানামা, আর সাইক্লোনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়—সবকিছুই এই প্রকল্পের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সমীক্ষার মঞ্চ
রবিবার সকালে, মহারাষ্ট্র থেকে আসা তিন সদস্যের দল জলাশয়ের ধারে তাদের যন্ত্রপাতি খুলে বসে। মনোজ মালেকার, দলের প্রধান হাইড্রো ইঞ্জিনিয়ার, বললেন, “নীলনির্জনের গভীরতা আর জলের গতিবিধি বুঝতে আমাদের আধুনিক ডিভাইস ব্যবহার করতে হবে।”
একটি বিশেষ ডিভাইস বসানো হলো জলাশয়ের গভীরে। এটি ২৪ ঘণ্টা ধরে তথ্য সংগ্রহ করবে—জলের তাপমাত্রা, ঢেউয়ের মাপ, লবণাক্ততা, আর স্রোতের গতি। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করবেন জিওলজিস্ট কৌশিক রায়।
ডিভাইস বসানোর সময় মনোজ তার দলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাপমাত্রা বেড়ে গেলে সৌর প্যানেলের কার্যকারিতা কমে যায়। আর ঢেউ যদি খুব বেশি হয়, প্যানেলের কাঠামো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তাই প্রতিটি তথ্য আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
জলাশয়ের স্মৃতি
নীলনির্জন জলাশয় কিন্তু একদিন এমনই ছিল না। আড়াই দশক আগে যখন এটি তৈরি হয়েছিল, তখন চারপাশ ছিল খোলা জমি। কিন্তু বছর যেতে যেতে কৃষিজমি আর বালি-পলিতে জলাশয়ের নাব্যতা কমেছে। জলাশয়ের বৃদ্ধ বয়স যেন প্রকল্পের শুরুর পথে অদৃশ্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মনোজ তার ল্যাপটপের স্ক্রিনে একটি ত্রিমাত্রিক মডেল দেখাচ্ছিলেন। “আমরা এখানে ডিজিটাল সিমুলেশন চালাচ্ছি। ঢেউয়ের শক্তি থেকে সাইক্লোনের গতিবেগ পর্যন্ত সবকিছু এখানে দেখা যাবে।”
“আপনি কি মনে করেন, প্রকল্পটি সফল হবে?” এক সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করলেন।
মনোজ একটু মুচকি হেসে বললেন, “প্রকৃতি যদি আমাদের সঙ্গে থাকে, তবে অবশ্যই। তবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
সবুজ শক্তির প্রতিশ্রুতি
ডিভাইস থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণের পর রিপোর্ট তৈরি হলো। তাতে দেখা গেল, জলাশয়ের তাপমাত্রা কিছুটা বেশি হলেও প্যানেলগুলো স্থাপনের ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা নেই। ঢেউয়ের উচ্চতা, স্রোতের গতি—সবই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গ্রিন এনার্জি প্রকল্পটির জন্য তৈরি হবে একটি সুবিশাল সাবস্টেশন। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পর সেটি গ্রিডে যুক্ত করা হবে। “আমরা যদি সফল হই, এটি দেশের অন্যতম বড় ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র হবে,” জানালেন প্রদীপ্তবাবু।
নীলনির্জনের নতুন ভোর
প্রকল্পের কাজ শেষ হলে, নীলনির্জনের বুক ভরে উঠবে ভাসমান সৌর প্যানেলের সারিতে। রোদের আলো জলে প্রতিফলিত হয়ে এক নতুন স্বপ্নের ছবি আঁকবে।
জলাশয় শুধু জল ধরে রাখে না, তার বুক থেকে ছড়িয়ে দিতে পারে অনন্ত সম্ভাবনা। আর নীলনির্জন সেই সম্ভাবনার সাক্ষী হয়ে উঠবে। প্রযুক্তি আর প্রকৃতির মিলনে গড়ে উঠবে এক সবুজ ভবিষ্যৎ।
|| সমাপ্ত ||
________