সিউড়ির ছোট্ট গ্রাম অজয়পুরে শীতকাল মানেই ছিল নিস্তেজ প্রকৃতি, খোলা মাটির গন্ধ, আর সাপের নিঃসাড় উপস্থিতি। গাঁয়ের প্রবীণরা বলতেন, শীতে সাপেরা ঘুমিয়ে যায়। তাই, ডিসেম্বর-জানুয়ারির ঠান্ডা রাতে কেউ আর সাপের ভয় পেত না। তবে এ বছরের শীত যেন অন্য রকম।
নভেম্বর মাস থেকেই গ্রামের মানুষ অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করতে শুরু করল। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও সাপ উদ্ধারের ঘটনা ঘটছে। সাপ দেখলেই গ্রামের ছেলেরা লাঠি হাতে এগিয়ে আসত একসময়। কিন্তু, দীনবন্ধু বিশ্বাসের মতো পরিবেশপ্রেমীদের প্রচেষ্টায় গ্রামের মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে। এখন সাপ দেখলেই বন দফতরে খবর দেয়।
দীনবন্ধু বিশ্বাস, অজয়পুর স্কুলের প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক, নিজে প্রায় প্রতিদিনই সাপ উদ্ধারে ছুটে যাচ্ছেন। ‘‘শীতের সময় সাপ এভাবে ঘুরে বেড়ায়, এটা আশ্চর্যের,’’ বলছিলেন তিনি। ‘‘গত বছরের তুলনায় এ বছর সাপের সংখ্যা যেন দ্বিগুণ বেড়েছে। গোখরো, দাঁড়াশ থেকে শুরু করে বিষধর কালাচ—সবাই যেন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছে।’’
দুবরাজপুরের অমিত শর্মাও পরিস্থিতি দেখে বিস্মিত। বন দফতরের হয়ে কাজ করতে গিয়ে তিনিও লক্ষ করেছেন, বিষধর সাপের সংখ্যাই এ বছর বেশি। ‘‘নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১৬টি বিষধর সাপ উদ্ধার করেছি। তার মধ্যে চন্দ্রবোড়া আর কালাচই বেশি,’’ অমিত জানান।
মানুষ ও সাপের সংঘর্ষ
শুধু সাপ দেখা আর উদ্ধারই নয়, এ বছর সাপের কামড়ের ঘটনাও বেড়েছে। সিউড়ি জেলা হাসপাতালের তথ্য বলছে, শীতেও সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। অক্টোবরে ২৬৯ জন, নভেম্বরে ২৫৯ জন, ডিসেম্বরে আরও বহু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ডাক্তারেরা বলছেন, সাপের কামড় থেকে বাঁচা সম্ভব, যদি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো যায়। ‘‘আমাদের প্রতিটি হাসপাতালে এভিএস মজুত আছে। তাই সময়মতো চিকিৎসা নিলে মৃত্যু ঠেকানো যায়,’’ জানালেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রি আড়ি।
কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে? লক্ষ্মীনারায়ণ মণ্ডল, সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ, বললেন, ‘‘সব সাপ শীতঘুমে যায় না। চন্দ্রবোড়া আর ময়ালদের জন্য এটা প্রজনন ঋতু। ফলে তারা শীতেও সক্রিয়।’’
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মানুষের আচরণগত পরিবর্তন। আগেকার দিনে সাপ দেখলেই মেরে ফেলার প্রবণতা ছিল। এখন সেই প্রবণতা কমেছে। ফলে সাপের সংখ্যা বেড়েছে। পাশাপাশি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে সাপেদের বাসস্থান সংকুচিত হয়েছে। ঝোপঝাড় কেটে ফেলা, শুকনো জমিতে আগুন দেওয়া—এসব কারণে সাপেরা মানুষের আশপাশে চলে আসছে।
গল্পের নায়ক: এক গ্রামবাসীর সাহসী পদক্ষেপ
অজয়পুরের মধ্যবয়সী কৃষক গৌরাঙ্গ মণ্ডল এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলেন। কুয়াশায় ঢাকা মেঠো রাস্তায় আচমকা পায়ের কাছ থেকে একটা ফিসফিস শব্দ শুনতে পেলেন। নিচে তাকিয়ে দেখলেন, এক বিশাল গোখরো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
গৌরাঙ্গ ভয় পেলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি জানতেন কী করতে হবে। দীনবন্ধু স্যারের প্রশিক্ষণে গ্রামে একটা পরিবেশ ক্লাব তৈরি হয়েছিল, যেখানে সাপ নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর কাজ হত। তিনি শান্ত থেকে বন দফতরে খবর দিলেন।
বন দফতরের কর্মীরা এসে সাপটাকে ধরে নিয়ে গেল। ‘‘একটু ভীত হলেও আমি জানতাম সাপকে মেরে ফেলা উচিত নয়। সাপও প্রকৃতির অংশ,’’ গৌরাঙ্গ মণ্ডল বললেন।
শেষ কথা
মানুষ ও সাপের এই সহাবস্থানের গল্পটা যেমন নতুন করে ভাবতে শেখায়, তেমনই একটি সতর্কবার্তাও দেয়। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে হলে সাপদের প্রজনন ঋতু, বাসস্থান সংকট, এবং মানুষের সচেতনতা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। আর শীতে, এই নিঃসাড় অথচ সক্রিয় সাপেরা যে তাদের অবস্থান জানান দিতে শুরু করেছে, তা ভুলে গেলে চলবে না।
বিঃদ্রঃ – সিউড়ির ঘটনা অবলম্বনে লিখিত।
|| সমাপ্ত ||
________