HomeStory of WestbengalHooghly: পৌষ মাসের বিশ্বকর্মা

Hooghly: পৌষ মাসের বিশ্বকর্মা

তাঁতশিল্পের অবস্থা আর আগের মতো নেই

বেগমপুরের ছোটোতাজপুর গ্রামে পৌষ মাসের শুক্লা পক্ষের নবমী তিথি এসেছে। শীতের ভোরে সকালের সোনালী রোশনির সঙ্গে শুরু হল অকাল বিশ্বকর্মা পুজো। দুর্গাপুজোর ঠিক ৯০ দিন পর, যখন মানুষ ঘরবাড়ির সাজসজ্জা আর আনন্দের মধ্যে মগ্ন থাকে, তখন এখানকার এক ছোটো গ্রামেও উৎসবের হাওয়া লেগে যায়। এ বছর, পুজো শুরু হওয়ার আগে গ্রামের প্রতিটি তাঁতঘরে ঝিমিয়ে থাকা মাকুর শব্দে জীবন ফিরেছিল। তাঁতিরা প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কারণ এটি শুধু একটি ধর্মীয় পুজো নয়, এটি তাদের অস্তিত্বের এক মূর্ত প্রকাশ।

বেগমপুরের পুজোর এক বিশেষ দিক হলো—বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে এখানে হাতির বদলে ঘোড়া থাকে। তাঁতিরা বলছেন, “ঘোড়ার খুড়ের খটখট শব্দের সঙ্গে আমাদের মাকুর শব্দের এক অদ্ভুত সাদৃশ্য রয়েছে। তাই প্রতি বছর বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে আমরা ঘোড়া পুজো করি।” তবে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত এক আশ্চর্য গল্পও রয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকে বেগমপুরের প্রতিটি বাড়িতে একটাই পরিচিত শব্দ—তাঁতের মাকুর। এটি ছিল এলাকার অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক অপরিহার্য অংশ। ছোটোতাজপুর, মনিরামপুর, দক্ষিণ খরসরাই সহ আরও কয়েকটি গ্রামে তন্তুবায় সম্প্রদায়ের মানুষরা অকাল বিশ্বকর্মা পুজো করতেন। বেগমপুরের তাঁতশিল্পীরা জানতেন, দুর্গাপুজোর আগে তাঁতের কাজ একেবারে সাঙ্গ করতে হবে, কারণ পুজোর পর থেকেই তাঁতশিল্পে ব্যস্ততার শুরু। আর তাই এই সময়টুকু ছিল তাঁদের জন্য এক বিশেষ সময়, যখন তাঁরা আবার বিশ্বকর্মার পুজো করতে পারতেন।

তবে, একসময় যা ছিল গর্ব, আজ তা বিষাদে পরিণত হয়েছে। গ্রামটির কিছু মানুষ বলছিলেন, “বেগমপুরে আগে পাঁচ হাজারেরও বেশি তাঁতশিল্পী ছিল। কিন্তু আজকাল তা একেবারে কমে গেছে। নতুন কোনো মানুষ আর এই পেশায় আসছেন না।” বেগমপুরের তাঁতিরা উদ্বিগ্ন, কেননা তাঁতশিল্পের অবস্থা আর আগের মতো নেই। অনেকেই মেলাতে গিয়ে নিজেদের হারানো সোনালী দিনগুলোর কথা মনে করে বলেন, “আগে যখন মেলা বসত, তখন গ্রামে গ্রামে তাঁতশিল্পের পণ্য বিক্রি হত। এখন রোজগার কমেছে।”

তবে, অকাল বিশ্বকর্মা পুজো প্রতি বছর যেমন আগের মতোই উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ভরা থাকে, তেমনি তাঁতশিল্পীদের মনে এক অদ্ভুত আশার আলোও জ্বলে ওঠে। মেলাতে আসা মানুষদের মুখে হাসি, ঘুড়ি উড়ানোর আনন্দ, এবং প্রতিমার পুজোর সময় তাঁতঘরের মাকুরের শব্দ—এই সব কিছুই যেন তাদের জীবনের নতুন দিশা দেয়। ঘোড়ার পায়ে খটখট শব্দের সঙ্গে, যেন তাঁতের মাকুরও আবার একটুকু হাসি ফেরাতে শুরু করেছে।

বেগমপুরের অকাল বিশ্বকর্মা পুজো স্রেফ ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি এখানকার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, এবং জীবিকা জড়িয়ে থাকা এক মহা আয়োজন। এই পুজো এক ধরনের পুনর্জন্ম, যেখানে প্রাচীন ঐতিহ্য এবং আধুনিক বাস্তবতার মাঝামাঝি দিয়ে গ্রামের মানুষ নতুন করে একে অপরকে জানাতে থাকে, তাঁদের শিল্পের মূল্য এবং তাদের সংগ্রামের ইতিহাস।

আজও বেগমপুরের পুজো আর তাঁর ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম চলছে। “ঘোড়া আর মাকুর—এরা আমাদের পেশার প্রতীক,” বলেন এক বৃদ্ধ তাঁতি। “বিশ্বকর্মা পুজো, আমাদের কামাল আনার দিন, আমাদের সৃষ্টির উৎস।”

বিঃ দ্রঃ – গল্পটি হুগলীর বেগমপুরের কাহিনী অবলম্বনে লেখা।

|| সমাপ্ত ||

________

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন