শীতের সকাল। ঠান্ডা হাওয়া আর দামোদর নদীর ধারে গাছের পাতার মিষ্টি মর্মরধ্বনি। বর্ধমানের কয়েকটি পরিবার মিলে পিকনিক করতে এসেছিল হরিপুর গ্রামের কাছে দামোদরের পাড়ে। খাওয়া-দাওয়া, গান, আর হৈ-হট্টগোলের মাঝে কেউই ভাবেনি, তারা ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়ের সাক্ষী হতে চলেছে।
দুপুরের দিকে কয়েকজন তরুণ নদীর ধারে হাঁটতে বের হয়। হঠাৎই একজন চিৎকার করে ওঠে, “এই দ্যাখ! এখানে কিছু জিনিস বেরিয়ে আছে বালির নিচে!” বাকিরা ছুটে আসে। সবাই মিলে হাত দিয়ে বালি সরাতেই ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে একটি মূর্তির আকৃতি। কারো মুখে কথা নেই। যেন হাজার বছরের পুরনো ইতিহাসের গন্ধ লেগে আছে সেই মূর্তিতে।
খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একসময় ছবিটি মিউজিয়ামের আধিকারিক শ্যামসুন্দর বেরার কাছে পৌঁছায়। তিনি ছবি দেখে চমকে যান। এত সুন্দর সূর্যমূর্তি, অথচ এটি এতদিন নদীর তলায় ছিল! তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারকে জানান। রেজিস্ট্রার বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন।
পুলিশ এসে মূর্তিটি উদ্ধার করে, এবং সেটিকে নিরাপদে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। রবিবার বিকেলেই মূর্তিটি দেখতে হাজির হন বহু মানুষ। মূর্তিটির উচ্চতা প্রায় তিন ফুট, প্রস্থ দেড় ফুট। এটি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছে ব্যাসাল্ট পাথর। শ্যামসুন্দর বেরা পরে জানান, এটি পাল-সেন যুগের একটি সূর্যমূর্তি। অনুমান করা হচ্ছে, এটি দশম বা একাদশ শতাব্দীতে তৈরি।
মূর্তিটির বিশেষত্ব দেখে চমকে যান প্রত্নতাত্ত্বিকরাও। এর উপর খোদাই করা রয়েছে কীর্তিমুখ ও উড়ন্ত বিদ্যাধর। মূর্তিটির মুখমণ্ডল ভাঙা থাকলেও এর সপ্ত-অশ্ববাহী রথ এবং একচক্র ডিজাইন স্পষ্ট দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি হয়তো বালি তোলার সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মিউজিয়ামের মেঝেতে স্থাপন করা হয় মূর্তিটি। তার সামনে দাঁড়িয়ে দর্শনার্থীরা অবাক হয়ে দেখেন প্রাচীন ভারতের সূক্ষ্ম কারুকার্যের নিদর্শন। স্থানীয় এক শিক্ষক বললেন, “এ যেন ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় খুলে দেওয়া হলো। আমাদের পূর্বপুরুষদের দক্ষতা আর শিল্পবোধের সাক্ষী এটি।”
এক বৃদ্ধা হাতজোড় করে প্রণাম করে বললেন, “এ মূর্তি শুধু পাথর নয়, এ হলো আমাদের অতীতের কথা বলার এক আশ্চর্য ভাস্কর।”
পিকনিক করতে এসে এমন এক অভিজ্ঞতা কে-ই বা ভুলতে পারে? দামোদরের পাড়ে পাওয়া সেই সূর্যমূর্তি শুধু একটি প্রাচীন শিল্পকর্ম নয়, এটি যেন হারিয়ে যাওয়া কাহিনির পৃষ্ঠা উল্টে নতুন গল্প বলতে শুরু করেছে। বর্ধমানের মানুষজনের জন্য এটি হয়ে উঠল গর্বের বিষয়। ইতিহাসের এই অসাধারণ আবিষ্কার প্রমাণ করে, কখনও কখনও আমাদের অতীত ঠিক নিজে থেকেই তার পথ খুঁজে নেয়।
বিঃদ্রঃ – পূর্ব বর্ধমানের রায়নার ঘটনা অবলম্বনে লিখিত।
|| সমাপ্ত ||
_______