রাইকা পাহাড়তলির উদলবনি প্রাথমিক বিদ্যালয়। চারিদিকে সবুজের সমারোহ, পাহাড়ের ঘন ছায়া, আর তার মাঝেই এক চিলতে খোলা মাঠে বসে পড়ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। তাদের মাথার ওপরে কেবল নীল আকাশ, আর সামনে এক রাশ আতঙ্ক। এই আতঙ্কের নাম—বাঘিনী।
গত দশ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে ক্লাস হলেও এবার পরিস্থিতি অন্যরকম। কিছুদিন আগে বাঘিনীর পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে স্কুলের কাছেই। তারপর থেকেই গ্রামের মানুষ, শিক্ষক, ছাত্র সবাই যেন দমবন্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে।
এক অস্বাভাবিক দিন
সেদিনও সকালটা অন্য দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। শিক্ষক বঙ্কিম হাঁসদা আর অনিতা মান্ডি একে একে মাঠে এসে বসে পড়েন। শিশুরা আসতে শুরু করে। প্রত্যেকের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।
“আজ অঙ্কের ক্লাস নেব,” বলে শুরু করেছিলেন বঙ্কিম হাঁসদা। কিন্তু পড়ুয়াদের মন যেন কোথাও নেই। মাঠের ধারে থাকা ঝোপের দিকে সবার চোখ। হঠাৎই ঝোপের পেছন থেকে একটি শব্দ ভেসে এলো। শিক্ষিকা অনিতা থমকে গেলেন। “আপনারা কিছু শুনলেন?”
বঙ্কিম মাথা নেড়ে বললেন, “হয়তো বাতাসে পাতা নড়ছে।”
ছায়া ও শিকারীর গন্ধ
ক্লাস চলতে থাকল। কিন্তু সবাই যেন অজান্তেই অপেক্ষা করছে কোনো ভয়ঙ্কর ঘটনার জন্য। হঠাৎ, মাঠের এক পাশে থাকা গরু হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠল। তাদের ডাকাডাকি থামছে না। শিক্ষিকা অনিতা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কিছু একটা হচ্ছে। সবাই সাবধান থাকো।”
ঠিক তখনই ঝোপের আড়াল থেকে একটি ছায়া দেখা গেল। বড়ো, সরু চোখ দু’টি ঝকঝক করছে। সেই মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারল—এটাই বাঘিনী।
ভয় ও প্রতিরোধ
বাঘিনী ধীর পায়ে মাঠের দিকে এগিয়ে আসছিল। শিক্ষকেরা দ্রুত শিশুদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন। বঙ্কিম হাঁসদা চিৎকার করে বললেন, “কেউ দৌড়াবে না! সবাই এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকবে।”
গ্রামের কিছু মানুষ, যারা দূরে দাঁড়িয়ে স্কুলের পরিস্থিতি দেখছিল, বাঘিনীর আসা দেখে তাড়াতাড়ি লাঠি আর টর্চ নিয়ে ছুটে এল। বাঘিনী গর্জন করে উঠল। তার গর্জন যেন পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল।
একটি দীর্ঘ রাত
বাঘিনী ধীরে ধীরে পিছু হটে গেল। সবাই বেঁচে গেলেও ভয় কাটল না। সেদিনের পর গ্রামজুড়ে আরও আতঙ্ক ছড়াল। বনদপ্তর তৎপর হলেও, বাঘিনীর উপস্থিতি যেন অদৃশ্য ছায়ার মতো রয়ে গেল।
শিক্ষক অনিতা মান্ডি রাতের বেলা জানালার ধারে বসে কাঁপতে কাঁপতে ভাবলেন, “বাচ্চাদের কীভাবে বাঁচাব? আর কতদিন এই ভয়ের মধ্যে বাঁচতে হবে?”
বাঘিনী হয়তো সেদিন চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার ছায়া থেকে গেল রাইকা পাহাড়ের গ্রামজুড়ে। খোলা আকাশের নিচে যে ক্লাস চলে, তার ওপর এখনো ভয়াল ছায়া ফেলে যায় এই মরণশিকারী।
বিঃদ্রঃ – পুরুলিয়ার বাঘের কাহিনী অবলম্বনে লেখা এই গল্প।
|| সমাপ্ত ||
________