Homeবর্ধমানWomen empowerment: লেদ কারখানার রিয়া

Women empowerment: লেদ কারখানার রিয়া

"একটা মেয়ে এই কাজ করবে? বেশিদিন টিকবে না!"— ধেয়ে আসতো কটূক্তি

কালনার ছোট্ট গলিপথ ধরে এগোলে এক কোণায় দেখা মেলে পুরনো এক লেদ কারখানা। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লোহার টুকরো, ভারী যন্ত্রপাতি, আর মেশিনের বিকট শব্দ। সেখানে কাঁচা ঘামের গন্ধে মিশে থাকে শ্রম আর সংকল্পের চিহ্ন। কিন্তু এই জায়গাটায় যেটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো, সেটা হলো—একজন মহিলা হাতুড়ি হাতে লোহা পেটাচ্ছেন!

রিয়া পাল, বয়স ২৯। চোখে লড়াইয়ের আগুন। আগুনের ফুলকি গায়ে এসে পড়লেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। লোহার রড হাতে নিয়ে নিখুঁত ছন্দে লেদ মেশিনে ফিট করছেন। একের পর এক যন্ত্রাংশের আকার দিচ্ছেন নিপুণ হাতে।

তবে এই জায়গায় পৌঁছানো মোটেও সহজ ছিল না। কয়েক বছর আগে অভাবের তাড়নায় যখন প্রথম লোহার কারখানায় কাজ শুরু করেছিলেন, তখন কেউ তাঁকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। “একটা মেয়ে এই কাজ করবে? বেশিদিন টিকবে না!”—এরকম কটূক্তি শুনতে শুনতে রিয়ার কান ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু রিয়া ভেঙে পড়ার মেয়ে নন। বরং প্রতিটা সন্দেহ আর অপমানকেই তিনি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন।

যেদিন তিনি লেদ কারখানায় কাজ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সেদিনও অনেকের ভ্রুকুটি ছিল। মালিক মধুসূদন হালদার প্রথমে দ্বিধায় ছিলেন, কিন্তু রিয়ার চোখের দৃঢ়তা তাঁকে আশ্বস্ত করেছিল। “শিখতে চাই, পারবও!”—এই কথাটা এমন জোর দিয়ে বলেছিলেন যে মধুসূদনবাবু আর না করতে পারেননি।

কাজ শুরু হলো। ভারী হাতুড়ি হাতে প্রথম দিন যখন লোহার পাতের ওপর আঘাত করলেন, হাত কেঁপে উঠেছিল। কিন্তু রিয়া হাল ছাড়েননি। প্রথম মাসে হাতে ফোস্কা পড়ল, হাতে-পায়ে ব্যথা হলো, কিন্তু তিনি শিখতে লাগলেন। আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে ওয়েল্ডিং শিখলেন, মেশিনের কাটিং বুঝলেন, একের পর এক দক্ষতা অর্জন করলেন।

এর মধ্যে সংসারের চাপও ছিল। স্বামী তপন রাজমিস্ত্রির কাজ করেন, সংসারের অভাব মেটাতে রিয়াকে দিনের কাজের পাশাপাশি রান্না, সন্তান সামলানো সবই করতে হয়। সকালে স্বামী কাজে বেরোলেই তড়িঘড়ি রান্না সেরে ছেলেকে স্কুলে দিয়ে চলে যান লেদ কারখানায়।

এখন রিয়া শুধু নিজের কাজ জানেন না, অন্যদেরও শেখান। যাঁরা প্রথমে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলেন, তাঁরাই এখন তাঁর দক্ষতায় অবাক। লেদ মালিক গর্ব করে বলেন, “একজন মেয়ে যে এতটা শিখতে পারে, এত কঠিন কাজ করতে পারে, সেটা আগে ভাবিনি।”

রিয়া শুধু নিজের জন্যই কাজ করছেন না, সমাজের চোখ খুলে দিয়েছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, শ্রমের কোনও লিঙ্গভেদ নেই। সমাজের তৈরি করা ‘নারীর কাজ’ আর ‘পুরুষের কাজ’-এর সীমারেখা তিনি মুছে দিয়েছেন।

রিয়া হাসেন, কিন্তু তাঁর চোখে দৃঢ় সংকল্পের ঝলক। “আমি শুধু নিজের জন্য নয়, অন্য মেয়েদের জন্যও কিছু করে দেখাতে চেয়েছিলাম। যদি কোনও মেয়ে দেখে সাহস পায়, তবে আমার পরিশ্রম সার্থক।”

রিয়ার গল্পটা শুধু এক নারীর সংগ্রামের নয়, এটা সমাজের পুরনো ধ্যানধারণাকে বদলে দেওয়ার গল্প। যে গল্প বলে—পরিবর্তন সম্ভব, যদি লড়াইটা মন থেকে করা যায়।

এই মুহূর্তে

আরও পড়ুন